পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১১

সড়ক সংস্কারে চরম অবহেলা : বড় প্রকল্প নিয়ে যত উত্সাহ

সরকারের চরম অবহেলার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক, কক্সবাজার-বান্দরবান মহাসড়কসহ সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, ফ্লাইওভার, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত, রেলের জন্য ওয়াগন ক্রয়সহ বড় বড় প্রজেক্ট নিয়েই ব্যস্ত থাকায় সড়ক সংস্কারের কথা একরকম ভুলেই যায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যার কারণে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পৌনে তিন বছরে সড়ক সংস্কারে কোনো কাজই হয়নি। অবশ্য সরকার দাবি করছে তাদের পৌনে ৩ বছরে ১০৭ কোটি টাকার সংস্কার কাজ হয়েছে। বরাদ্দকৃত ১০৭ কোটি টাকার কাজও ঠিকমত হয়নি বলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ১০৭ কোটি টাকার সংস্কার কাজ হলে সারাদেশের সব সড়কের এমন বেহাল দশা হবে কেন? সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, মহাসড়কগুলোর বেহাল দশার কথা সড়ক ও জনপথ বিভাগ বার বার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর জরুরি পুনর্বাসনের জন্য ১৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা দু’বছর আগে জানায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। পরে ‘সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর জরুরি পুনর্বাসন’ শীর্ষক দেড় বছরে বাস্তবায়নের জন্য ১৪১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদিতও হয়। কিন্তু অনুমোদিত ১৪১০ কোটি টাকার মধ্যে প্রথম বছর ৫০ কোটি এবং পরের বছর ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দাবি করছে, একনেকের অনুমোদন থাকলেও রাস্তা সংস্কারে টাকা ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। যার কারণে তারা সংস্কার কাজ ঠিকমত করতে পারেনি।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পত্রপত্রিকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর টনক নড়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। এরপর সড়ক-মহাসড়কের জরুরি সংস্কার করতে ২৮০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ডিও পাঠিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। গত ১০ জুলাই মেট্রো রেল সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও ব্যক্তিগতভাবে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী চিঠিতে বলেছেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অনুমোদিত ১৫২টি প্রকল্পের অনুকূলে জিওবি খাতে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে কমপক্ষে ২ হাজার ৪৬০ কোটি ৯২ লাখ টাকা বরাদ্দের চাহিদা দেয়া হলে তার বিপরীতে মাত্র ১ হাজার ৫০ কোটি ১৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, যা বরাদ্দ চাহিদার ৫৭ দশমিক ৩২ ভাগ। বিগত সরকারের চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে জনদুর্ভোগ লাঘব ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকার ‘সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সড়কসমূহের জরুরি পুনর্বাসন’ প্রকল্প গ্রহণ করে। দেড় বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫৭ কোটি এবং চলতি অর্থবছরে ৫০ কোটিসহ মোট ১০৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। বাকি ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা ছাড় করেনি অর্থ বিভাগ।
তহবিলের অভাবে সময়মত রাস্তা মেরামত করা না গেলে পরে আরও ৩-৪ গুণ টাকা বেশি প্রয়োজন হবে উল্লেখ করে একই চিঠিতে বলা হয়, এ প্রকল্পের অনুকূলে আরও ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে ৮০০ কোটি টাকা এবং সারাদেশের ৫৩টি প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। গত ২১ জুলাই এ বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপে ‘রাস্তা সংস্কার করা জরুরি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক’ বলে অনুশাসন প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরও কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি অর্থ বিভাগ।
সময়মত রাস্তা সংস্কার না করায় এখন ১৫০০ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে বলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছেন যোগাযোগমন্ত্রী। চিঠিতে তিনি সড়ক ব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, সড়ক সংস্কারের জন্য অর্থ চেয়ে বার বার অনুরোধ জানানো হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি। ফলে এরই মধ্যে সড়কের অবস্থা আগের চেয়ে আরও বেশি খারাপ হয়েছে। নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার/মেরামতের জন্য ডিপিপিভুক্ত প্রকল্পে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। আবার সংস্কার/মেরামত খাতেও তেমন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে ডিপিপির বাইরের সড়কগুলোর সংস্কার/মেরামত অব্যাহত রাখার জন্য ‘সংস্কার ও মেরামত খাতে’ জরুরি ভিত্তিতে আলাদা আরও ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। যথাসময়ে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত ১৪১০ কোটি টাকা পাওয়া গেলে এত অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হতো না।
চিঠিতে সড়ক সংস্কারে ২৮০৩ কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, সড়ক খাতে দীর্ঘ অবহেলার কারণে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও বরাদ্দের ক্ষেত্রে সড়ক খাতটি বিশেষ করে সংস্কার ও মেরামত খাতটি গুরুত্ব পায়নি। অথচ সড়ক যোগাযোগ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে সড়ক খাতে যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা দ্রুত কেটে ওঠা সম্ভব হবে বলে তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই নাজুক যে, এরই মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে রাজধানী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে দক্ষিণবঙ্গের বেশক’টি জেলাও। টাঙ্গাইল-যমুনা সেতুর ৭০ কিলোমিটার মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় এটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গোটা উত্তরবঙ্গ থেকে রাজধানী বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
সূত্র জানায়, গাজীপুর হয়ে চলাচলকারী ১২টি রুটের যান চলাচল বন্ধ রাখায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যাতায়াতকারী কয়েক লাখ মানুষ। মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্তে এসব রুটে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ক’দিনের টানা বর্ষণে রাস্তা ভেঙে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর এলাকার ৭টি পয়েন্ট মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। মহাসড়ক সংস্কার না করা পর্যন্ত পরিবহন মালিকরা যানবাহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তার দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত ৩৫টি পয়েন্টে রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে শত শত খানাখন্দ। চান্দনা চৌরাস্তার দক্ষিণে বিশ্বরোড, মালেকের বাড়ি, সাইনবোর্ড, আইইউটি গেটের বিপরীত পাশে, হাজীরপুকুর ম্যাট্রিক্স সোয়েটারের সামনে, টঙ্গী পৌরসভার বিপরীতে এবং স্টেশন রোডের ওভারব্রিজের নিচের স্থান এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এছাড়া শতাধিক জায়গায় রাস্তার পিচ উঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরে আবদুল্লাহপুরের পরই গাজীপুর পর্যন্ত দুটি শিল্পনগরীতে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা, ৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, সমরাস্ত্র কারখানা এবং একমাত্র টাঁকশালসহ একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘিরে প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা শহরের ভেতর দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশের মহাসড়কটির অবস্থা অত্যন্ত করুণ। প্রশাসনের খামখেয়ালিপনা এবং কাজ না করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কারণে বছরজুড়েই মহাসড়কের এ অংশটির বেহাল দশা চলছে। একদিকে ভাঙা রাস্তার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ছে গাড়ি; আবার ভাঙা-সরু ২ লেনের রাস্তায় ধীরগতির জ্যামে আটকে নষ্ট হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়। আবার সে সময় মেকআপ করতে রাস্তা একটু ফাঁকা/ভালো পেলেই বেপরোয়া লাগামছাড়া গতিও দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কটি চার লেন করার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়মের কারণে এর একটি বড় অংশের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুটি অংশেও একইরকমের অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রায় এক যুগ ধরে বড় ধরনের মেরামত না হওয়ায় সড়কে যত্রতত্র গর্ত আর তাতে পানি জমে মহাসড়কটি এখন চলাচলের অনুপযোগী। সর্বশেষ গত বুধবার থেকে এ মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী যান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। মেরামতের অভাবে প্রায় একই অবস্থা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও মির্জাপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সড়ক, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশ ও যশোর-খুলনা মহাসড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশের অবস্থাও বেশ নাজুক। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) সূত্র জানায়, এখনই মেরামত না করলে যে কোনো সময় এসব সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে গাজীপুর, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাস বন্ধ থাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-জামালপুর পথের ট্রেনগুলোতে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। মালবাহী যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ওই পথ ব্যবহারকারী ব্যবসা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন