গুরুতর সব অভিযোগ মাথায় নিয়েই চলেছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের অনিয়ম, দুর্নীতি সম্পর্কে মন্ত্রণালয় ও ডিসিসি একে অপরকে দোষারোপ করছে। মেয়র বলছেন, মন্ত্রণালয় সব জানে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বলেছেন, তারা কিছুই জানেন না। বার বার ব্যয় বৃদ্ধি, নকশা পরিবর্তন, ব্যাংকের টাকা লুটপাট এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রত্যাহারসহ নানা জটিলতা ও দুর্নীতি তথ্য দেশের আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাজ চলছে। টেন্ডারে প্রাপ্ত দর থেকে হিসাব করলে ফ্লাইওভারের নির্মাণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় গুণ। বিএনপি সরকারের আমলে যে দামে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিলো সেটিকে ভিত্তি হিসাবে ধরলেও দাম বেড়েছে তিন গুণ। কিন্তু, এভাবে দফায় দফায় দাম যে বাড়ানো হচ্ছে তাতে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের অপরিহার্যতা থাকলেও সেইসব রীতিনীতির কিছুই অনুসরণ করা হচ্ছে না।
ফ্লাইওভারটি নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড। মূল প্রতিষ্ঠান বেলহাসা ইতিমধ্যে তাদের শেয়ার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্য অংশীদার ওরিয়ন গ্রুপ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সিমপেঙ্ ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে নিযুক্ত করেছে, যা কোন নিয়মনীতির মধ্যে পড়ে না। লি গ্রুপকে নিয়োগ করা হয়েছে কনসালট্যান্ট হিসেবে।
নিয়ম অনুযায়ী, কোন টেন্ডারের মূল্য ১০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। তবে তাতেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে ৩০০ শতাংশ করা হয়েছে, যা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান বাধ্যতামূলক ছিলো। কিন্তু, তা করা হয়নি। যে কারণে সংশ্লিষ্ট মহল এসব কর্মকা-কে রামরাজত্ব, এমনকি কেউ কেউ মহাজালিয়াতি ও মহাদুর্নীতি বলেও আখ্যায়িত করছেন, যার নজির অতীতে নেই।
এদিকে জানা গেছে, ইউটিলিটি স্থাপনা বহাল রেখেই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ ঝুঁকির মধ্যে এগিয়ে চলেছে। এজন্য যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটারও আশংকা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞ জানান।
মন্ত্রণালয় অন্ধকারে
নির্মাণ কাজ শুরু হলেও গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ফ্লাইওভারের চলমান নির্মাণের বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে তারা। কোনোই খবরদারি নেই মন্ত্রণালয়ের। মূল টেন্ডার পার্টি যাদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা দেখে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছিলো, তাদের অনেক আগেই প্রতারণার মাধ্যমে বঞ্চিত করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। এ প্রকল্পের পুরো কর্তৃত্ব এখন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের কাছে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ওরিয়ন তাদের খেয়াল-খুশি মতো চালাচ্ছে এ বৃহৎ স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই ফ্লাইওভারের কাজে হাত দেয়া হয়েছিল। অবকাঠামো খাত উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করাই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য। ওই সময় টেন্ডার মূল্যায়নসহ সার্বিক কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পটি তখন সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলো। জোট সরকারের আমলে মন্ত্রণালয়ের কেরামতিতে অনৈতিকভাবে টেন্ডার মূল্য বাড়িয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এছাড়া ফ্লাইওভারের যে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন তৈরি করা হয় সেটিও ছিলো ত্রুটিপূর্ণ। মূলত এসব কারণে কেয়ারটেকার সরকারের সময় প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। এরপর মামলা হলে তা আর্বিট্রেশন মামলায় গড়ায়। এ মামলা এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না হলেও ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম সরকারের একটি অংশের সাথে অবৈধ অাঁতাত করে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু করে দেয়। উদ্বোধনের পূর্বে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পের সার-সংক্ষেপ চাওয়া হয়। তখন স্থ্থানীয় মন্ত্রণালয় থেকে যে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয় তাতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, এতে প্রকৃত ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়। এরপর ওবায়দুল করিমের ঘনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে ফের মন্ত্রণালয়কে সার-সংক্ষেপ পাঠাতে বলেন। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দুর্নীতির মামলায় জড়ানোর ভয়ে সেইভাবে সার-সংক্ষেপ পাঠাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের ধমকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ওইভাবে সার-সংক্ষেপ পাঠাতে বাধ্য হন। এরপর আর ফ্লাইওভার নির্মাণে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকেনি। একসময় মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ হয়ে তদারকির পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেয় ওরিয়ন গ্রুপের হাতে। ডিসিসি তাদের সাথে থাকলেও তা নিতান্তই নামে মাত্র। এর মাধ্যমে বরং ডিসিসি'র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছে। এছাড়া ডিজাইন, ব্যয় নির্ধারণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মীমাংসার জন্য টেকনিক্যাল কমিটি করেছিল মন্ত্রণালয়। ওরিয়ন গ্রুপের মনঃপূত না হওয়ায় এখন এ দু'টি কমিটির কোন কার্যক্রম নেই। এখন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ বিহীন ওরিয়নের ইচ্ছা অনুযায়ী চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ।
প্রকল্পের ব্যয় যেভাবে বাড়ানো হলো
নির্মাণাধীন গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের বিনিয়োগ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। নকশা পরিবর্তন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দৈর্ঘ্য বাড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। তবে যত না দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করা হয়েছে তাতে ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ছয় গুণ। প্রকল্প শুরুর গোড়ার দিকে ২০০৩ সালের বেসরকারি বিনিয়োগে বিওওটি পদ্ধতিতে নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান সেই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান কারিগরি মূল্যায়নে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হয় বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড। ফ্লাইওভার নির্মাণে তাদের দর ছিল ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সেটিকে জালিয়াতির মাধ্যমে জোট সরকারের আমলে কার্যাদেশ দেয়া হয় ৬৬০ কোটি টাকায়। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে; কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ২২ জুন এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এসময় ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকায়। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে, সে কারণেই নাকি দাম বেড়েছে। কিন্তু, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর এই নতুন নকশা কে অনুমোদন করেছে, ব্যয় বৃদ্ধিই বা কে মূল্যায়ন করেছে, কে অনুমোদন করেছে- এসবের কোন বালাই নেই।
দরপত্রের শর্তভঙ্গ
মালিকানার অংশ পরিবর্তন হওয়ার কারণে কোম্পানিতে বেলহাসার সংশ্লিষ্টতা নেই। কার্যত এখন এর মূল মালিক ওবায়দুল করিমের ওরিয়ন গ্রুপ। অথচ বড় স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ওরিয়ন গ্রুপের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারা অন্য কোম্পানির সহায়তায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ সমাধা করবে বলেছে। এতে দরদাতা নির্বাচনের মূল বিবেচ্যটি আর থাকলো না। নিয়মানুযায়ী এতে দরপত্র চুক্তি বাতিল হয়ে পুনঃটেন্ডার হওয়ার কথা। কিন্তু পুনঃটেন্ডারের পরিবর্তে বিশেষ মহলের তদবিরে সেই অবৈধ প্রতিষ্ঠানকেই ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো অন্ধকারে
গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পের নামে অগ্রাধিকার শেয়ারের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে নেয়া ৬শ' কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ওবায়দুল করিমকে নজিরবিহীনভাবে দেশের পাঁচটি ব্যাংক এ টাকা দেয়। ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগের কোনো নিয়ম-কানুন এখানে মানা হয়নি। ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে উঠানোর আগে বোর্ড মেমোতে এটাচমেন্ট বা ব্রিফিং হিসেবে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনের যে নিয়ম-কানুন এক্ষেত্রে তা মোটেই মানা হয়নি। এই শেয়ারের বার্ষিক সুদ ধরা হয়েছে শতকরা ১০ শতাংশ। তিন বছরে এই অগ্রাধিকার শেয়ার সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরিত হবে। অভিযোগ রয়েছে, সিকিউরিটিজ এন্ড এক্্রচেঞ্জ কমিশন থেকে এ ব্যাপারে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। কাজ শুরুর আগেই ৫টি ব্যাংক থেকে এই ৬শ' কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। জনতা ব্যাংক ২শ' কোটি, সোনালী ব্যাংক ১৫০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১৫০ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি এবং আইসিবি ৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কিন্তু তাদের রাখা হয়েছে প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ থেকে যোজন যোজন দূরে। প্রকল্পের পরিচালনা কমিটিতে এই ব্যাংকগুলোর একজন করে কর্মকর্তাকে সদস্য হিসেবে রাখা হলেও তারা আছে নামেমাত্র। কখনো বিশেষ বৈঠক ডাকা হলে শুধুমাত্র সেখানেই এদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ আছে। এছাড়া প্রকল্পের কাজকর্মে তাদের কিছুই বলার অধিকার নেই। অথচ প্রকল্পের কাজ চলছে ব্যাংকগুলোর অর্থেই। ওবায়দুল করিমের এতে তেমন কোন বিনিয়োগ নেই বলতে গেলে।
পরিসেবা খাতের স্থাপনা স্থানান্তরের কাজে অচলাবস্থা
প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন পরিসেবা খাতের স্থাপনা স্থানান্তরের কাজে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। পানি, গ্যাস এবং টেলিফোন লাইনসহ বিভিন্ন পরিসেবা খাতের স্থাপনা এখনো রয়ে গেছে। শুরুতে পরিসেবা খাতের স্থাপনা স্থানান্তরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। সম্ভাব্য এই ব্যয়ের ১০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল ডিসিসি'র ভাগে। আর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বেলহাসা-একম এন্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড-এর ভাগে ১৫ কোটি টাকা। এই ব্যয় বাড়িয়ে ৩৪১ কোটি টাকায় দাঁড় করানো হয়েছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে হলে এসব স্থাপনা স্থানান্তর অপরিহার্য। কিন্তু, ইউটিলিটি সরানোর কাজ এখন পর্যন্ত শুরুই করা যায়নি। বাধামুক্ত প্রকল্প এলাকা হস্তান্তর বিলম্বিত হওয়ায় প্রথম দিক থেকে এ ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্প্রতি কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হলেও তারা এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি। কারণ, ওরিয়ন গ্রুপ এই ব্যয়ের পুরোটাই সরকারের ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র করছে। ডিসিসি'র মাধ্যমে এই ব্যয় করানোর জন্য নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে তারা। পরিসেবা খাতের স্থাপনা স্থানান্তর না করেই ইতিমধ্যে ফ্লাইওভারের ৫৫০টি পাইল, ৪০টি পাইল ক্যাপ, ২৫টি পিয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ফ্লাইওভারের উপরিভাগের বিভিন্ন কাজও বর্তমানে চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির মোট কাজের ৩০ শতাংশ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা দাবি করছেন।
ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়নের যত জালিয়াতি
বেলহাসা-একম লিমিটেডের দরপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল বিদেশি বিনিয়োগ ও দুবাইভিত্তিক অভিজ্ঞ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বেলহাসার এ কোম্পানিতে বড় অংকের মালিকানা। প্রকল্প শুরুর দিকে বেলহাসার শেয়ার ছিল শতকরা ৮০ শতাংশ। পরে এক পর্যায়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বেলহাসার শেয়ার মাত্র ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। জালিয়াতির কারণে বেলহাসা এ ৫ শতাংশ শেয়ারও ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিমই এখন এর পুরো কর্তৃত্বে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, দুবাইভিত্তিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনট্রাকটিং কোম্পানি ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন হাউসের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একম ইঞ্জিনিয়ারিং যৌথভাবে দরপত্র দাখিল করে। যৌথভাবে তারা কাজটি পায়। দু'টি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একত্রে বেলহাসা একম এ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লি. হিসেবে পরিচিত ও গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ওবায়দুল করিমের জালিয়াতির কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। ওবায়দুল করিম তার ছেলে সালমান করিম, জামাতা মেহেদী হাসানকে দরপত্রের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটিতে অংশীদার ও পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সময় বেলহাসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদ আহমেদ সাইফ-এর স্বাক্ষর জাল করে কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয়। বেলহাসা একম এ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লি.র গঠনতন্ত্র প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গঠন করেছেন ওবায়দুল করিম। গত বছরের ২৬ জুলাই যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম এ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড গঠনতন্ত্র অবৈধ দাবি করে ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটির দুবাইভিত্তিক অংশীদার বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড কনট্রাকটিং কোম্পানি। মামলায় ওবায়দুল করিম ছাড়াও তার জামাতা ও ছেলেকে আসামী করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির গঠনতন্ত্র বাতিল চেয়ে মামলাটি দায়ের করেন বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড কনট্রাকটিং কোম্পানির ব্যবস্থাপক পরিচালক মাজেদ আহমেদ সাইফ, বেলহাসার পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া।
এদিকে জানা গেছে, বর্তমানে কোম্পানির ১শ' কোটি টাকার যে পরিশোধিত মূলধন দেখানো হয়েছে এতেও ঘাপলা রয়েছে। বিনিয়োগ পরিকল্পিত নথিপত্রে দেখানো হয়েছে, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১শ' কোটি টাকা। ইতিমধ্যে এ শেয়ারগুলো ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু তা ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নগদ ও ব্যাংক তহবিল মিলে মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬ হাজার টাকা। ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেসে ৩২ কোটি ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ড্রইং, ডিজাইন এবং টেন্ডার দলিলপত্র তৈরিতে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, সরেজমিনে সার্ভের জন্য ৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ট্রাফিক স্টাডিতে ৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, মাটি পরীক্ষায় ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, লিগ্যাল ফি ৫২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পাইলিং টেস্টে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন