পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১১

গোপন দলিল ফাঁস : কানাডার খনিজ সম্পদের ওপর সিআইএ’র নজর


বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজের প্রভাব নিরঙ্কুশ করতে অন্য রাষ্ট্র পছন্দ করুক বা না করুক তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো এবং গোয়েন্দাবৃত্তি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এজন্য দেশটির রয়েছে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা। এখন ততটা বিস্তৃতভাবে না হলেও বার্লিন দেয়ালের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সিআইএ নিকটতম প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব দেশেই ব্যাপক তত্পরতা চালিয়েছে; এ ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই ছিল না। দেশের স্বার্থ অটুট রাখতে অন্য রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, খনিজ সম্পদ, পরিবেশ দূষণ, আর ভবিষ্যত্ সম্ভাবনা থেকে শুরু করে নাগরিকদের স্বভাব-চরিত্র, এমনকি জীববৈচিত্র্য সম্পর্কেও নীতি-নির্ধারকদের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা এবং তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করাই মূলত সিআইএর এই সময়ের কাজ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দেশে তথ্য অধিকার আইন পাস করার পর শীতল যুদ্ধের সময়ে সিআইএর তত্পরতা বিষয়ে অবমুক্ত করা প্রতিবেদন থেকে বিশ্ববাসী অনেক কিছু জানতে পারছে। তবে অবমুক্ত করা এসব প্রতিবেদনে শীতল যুদ্ধের সময় সিআইএর অনেক দেশে সরকার উত্খাতে সরাসরি ভূমিকা রাখা কিংবা প্রয়োজনে ভিন্ন মতাবলম্বী রাষ্ট্র নায়কদের হত্যা করে পছন্দমত ব্যক্তিকে সরকার ক্ষমতায় আসীন করানোর মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো থাকে না। সম্প্রতি কানাডার গণমাধ্যম সিআইএর অবমুক্ত করা অন্তত এক ডজন প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে, যাতে দেখা যায় সিআইএর গোয়েন্দা পরিদফতর ১৯৭২ সালে কানাডার অর্থনীতি নিয়ে দুটি গোপন প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সঙ্গে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বৈঠকের আগে প্রস্তুত করা ওই প্রতিবেদনে ট্রুডোকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে, তৃতীয় বিশ্বের নেতা এবং অগ্রসর ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর সবচেয়ে খাঁটি খেলোয়াড় হওয়ার বাসনার দোলাচলে পিষ্ট হওয়া একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে সিআইএর মূল্যায়ন, ট্রুডো চান কানাডা তার তৃতীয় বিশ্বের ভাবমূর্তি পরিহার করুক। ট্রুডো সরকারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও উচ্চাভিলাষ সম্পর্কেও বিশ্লেষণী মন্তব্য করা হয় ওই দুই প্রতিবেদনে। তবে এতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, কানাডার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণে কানাডার অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান চাপের বিষয়টি। ১৯৭২ সালের মে মাসে প্রণীত প্রতিবেদনে কানাডার খনিজ সম্পদ নিয়ে সিআইএর গভীর পর্যবেক্ষণ ও আগ্রহের বিষয়টি সবচেয়ে লক্ষণীয়, যেখানে তন্নতন্ন করে মূল্যায়ন করা হয়েছে কানাডার খনিজ সম্পদ ও উত্তোলন পরিস্থিতি। আথাবাস্কা নদী এলাকায় কানাডার বিশাল তেল ভাণ্ডার রয়েছে বলেও সিআইএ জানায়। তবে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় খনিজ রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চমত্কার সম্ভাবনা থাকার পরও কানাডা মার্কিন বাজার ও দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির ওপর নির্ভরশীল থাকবে বলে সিআইএ সে সময়মত প্রকাশ করে।
এতে আরও তুলে ধরা হয়, আলবার্টা রাজ্যের বিটুমিন-সমৃদ্ধ খনিজের ব্যাপারে জাপানের সম্ভাব্য আগ্রহের বিষয়টিও। পাশাপাশি তালিকায়ন করা হয়, কানাডার নৌজাহাজ সংক্রান্ত গতিধারা। সিআইয়ের ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে কানাডার মেলামেশার বিষয়ে অব্যাহত গভীর নজরদারি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
সিআইএর ইতিহাস এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর অবস্থান শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় অংশ নেয়া ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর ইতিহাসের অধ্যাপক ওয়েসলি ওয়ার্ক বলেন, কানাডা কখনোই মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের প্রধান লক্ষ্য হবে না, কিন্তু সময় সময় পরিষ্কারভাবে মার্কিন গোপন নজরদারির লক্ষ্যবস্তু হয়ে ধরা দেবে। তিনি বলেন, সিআইয়ের দলিলে বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বার্থ হাসিলের জন্য কানাডার যেসব বিষয় তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে বিশদ তথ্য খুঁজে পেতে মাঝেমধ্যে গোপন বিদ্যা কাজে লাগায়।
ট্রুডেউ সরকারের আমলে দুটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার একযুগ পর সিআইএ মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের জন্য কানাডার দ্বিধাগ্রস্ত অর্থনীতি নিয়ে আরও একটি বিস্তারিত মূল্যায়ন তুলে ধরে; যেখানে বলা হয়, প্রায় ক্যালিফোর্নিয়ার সমান বাণিজ্যিক বাজার নিয়েও কানাডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ছায়ায় থাকার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ১৯৮২ সালের জানুয়ারির এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে লিবারেল পার্টির সরকার যে জ্বালানি ও প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোয় কানাডার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে ব্যাপারেও গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
কানাডার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দাবৃত্তির সবচেয়ে পুরনো প্রতিবেদনটি ১৯৫৩ সালের, যাতে স্পর্শকাতর অনেক বিষয়ের পাশাপাশি কানাডার ভূমি ব্যবহার, জীবজন্তুর জীবন, খনিজ সম্পদ, বৈদ্যুতিক শক্তি, স্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে বিস্তারিতভাবে মূল্যায়ন করা হয়। বিশাল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডার যাবতীয় বিষয়ে আগ্রহী ছিল সব সময়ই। তবে কানাডা সম্পর্কে বিস্তৃত পরিসরে মার্কিন সরকারের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের অন্যতম একটি কারণ, মস্কোর প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে তার মেলামেশা ও বেশকিছু চুক্তি। এর মধ্যে কানাডার কাছ থেকে ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৪৫ মিলিয়ন ডলারের গম কেনা এবং হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেয়ার উপক্রম করা কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র মিসাইল সঙ্কটের সময় কানাডার কিউবার সঙ্গে রফতানি চুক্তি অন্যতম। এই প্রতিবেদনে সমুদ্র পথে ইতালি হয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার পথে কানাডার ৫৬০ টনের অ্যালুমিনিয়াম পাঠানোর সম্ভাবনার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
কানাডার গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া সিআইএর গোপন প্রতিবেদন কানাডিয়ানদের মধ্যে স্বভাবতই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। সাধারণ মানুষ বিষয়টি কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের সন্দেহ আরও জোরদার হবে। অধ্যাপক ওয়েসলি ওয়ার্ক মনে করেন, কানাডা সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে সিআইএর গোপন তত্পরতার বিষয়টি স্বীকারের পর কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় চুক্তি ও সম্পর্কে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দি গ্লোব অ্যান্ড মেইল অবলম্বনে গোলাম সরোয়ার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন