পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১১

জৈন্তাপুরের জমি বাংলার ভূমি

পাকিস্তানি শাসনের পঁচিশ বছরে এ সমস্যার কথা কখনও শুনিনি। নানা সরকারের শাসনে এগিয়ে চলা স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত চল্লিশ বছরেও এমন ঘটনার কথা কানে আসেনি। এখন হঠাত্ ভারতের কেন এমন দুর্মতি? কেন জৈন্তাপুর-পদুয়া-গোয়াইনঘাট সীমান্তে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলে তাদের অশুভ পাঁয়তারা? এ নিয়ে সৃষ্ট সেখানকার অশান্তিকর পরিস্থিতি প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারই বা এত নির্লিপ্ত কেন? বেশ কিছুদিন ধরেই তো অশান্তি দানা বেঁধে উঠেছে ওই এলাকায়। সৃষ্টি হয়েছে এক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির। সীমান্তবর্তী মানুষদের চাষ করা ধান কাটতে বাধা দিয়েছে ভারতের বিএসএফ। যে জমিতে ধান সে জমিকে ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করেছে তারা। দাবি করেছে ওই জমির ওপর তাদের দখল। জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেয়া কোনো পদক্ষেপের কথা জানতে পারিনি। বিএসএফকে যথোপযুক্তভাবে যারা বরাবর মোকাবিলা করে এসেছে সেই ‘সীমান্ত শার্দুল’ বিডিআর গভীর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এদের শূন্য স্থান পূরণ করা হয়েছে যাদের দিয়ে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে গঠিত সেই বিজিবি, তারা ভালোই জানে তাদের ভূমিকা হবে নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের মতো। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংঘাত-সংঘর্ষ তো দূরের কথা, তাদের কার্যক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে, কোনোক্রমেই যাতে বিএসএফ-এর বিরাগভাজন না হতে হয় সে ব্যাপারে তারা সতর্ক।
এমন অবস্থায় বলাই বাহুল্য যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এখন একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর। তাদের এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের সেই মর্মন্তুদ ও রহস্যাচ্ছন্ন বিডিআর ট্র্যাজেডির সময় থেকে। বিডিআর নামে কিছু আর তখন থেকেই ছিল না। বাংলাদেশের সীমান্ত হয়ে পড়েছিল অরক্ষিত। তখন বিএসএফ-ই নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশের সীমান্ত দেখভালের। তখন থেকেই সীমান্তে তাদেরই আধিপত্য। বাংলাদেশের নবগঠিত সীমান্ত রক্ষাবাহিনী বিজিবি আর কোনোমতেই বিএসএফ’র প্রতিপক্ষ নয়, তারা বিএসএফ’র সহযোগী। বর্তমান সরকারের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী ভারত যেমন বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, এদেশের মুরুব্বি, ‘অকৃত্রিম বন্ধু’, সহযোগী। কিন্তু এই সহযোগীরা যখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকে ধান কেটে নিয়ে যায়, বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে তাদের অংশ বলে দাবি করে তখনও কি বাংলাদেশের কিছু করার নেই? নতজানু হয়ে তাদের সবকিছু মেনে নেয়া ছাড়া? অন্তত সিলেটের জৈন্তাপুর-পদুয়া-গোয়াইনঘাটের ঘটনার ক্ষেত্রে তাই তো দেখা যাচ্ছে। খবরে পড়েছি, এই সীমান্তের ২৬১ একর জমি বাংলাদেশ তুলে দিচ্ছে ভারতের হাতে।
কেন এবং কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ তার নিজ ভূখণ্ডের ২৬১ একর জমি ভারতকে দিয়ে দিচ্ছে সে ব্যাপারে সরকারের কোনো ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। দেশের মানুষ, দেশের সম্পদ, দেশের মাটি মাঠ ফসলের হেফাজতকারী কোনো সরকার যে দেশের স্বার্থ বিরোধী এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে তা বিশ্বাসই করা যায় না। খবরে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে নাকি দুই দেশ যৌথভাবে একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। তবে সেটি নাকি গোপন জরিপ। সেই জরিপের ভিত্তিতেই ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ২৬১ একর জমি। এলাকার শান্তির স্বার্থে ভারতকে ভূ-দানের এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে সিলেটের জেলা প্রশাসন স্থানীয় অধিবাসীদের জানিয়েছে।
অজুহাত বটে একটা! নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার পক্ষে কী হাস্যকর সাফাই। এলাকার শান্তি বলতে প্রশাসন কাদের শান্তির কথা বলতে চেয়েছে? এই পরিমাণ জমি ভারতের হাতে তুলে দিয়ে তারা কাদের শান্তি নিশ্চিত করতে চায়? এই সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশী অধিবাসীরা, যাদের জমি কেড়ে নিয়ে ভারতীয়দের দেয়া হচ্ছে, এই শান্তি কি তাদের জন্য? ভারতকে ভূ-দানের এই পদক্ষেপে তাদের জীবনে তো সৃষ্টি করা হচ্ছে চির অশান্তি। তাদের অশান্তির বিনিময়ে প্রকৃত অর্থে শান্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে সীমান্তের ওপারের ভারতীয়দের। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের এই জমির ওপর যাদের লোলুপদৃষ্টি দীর্ঘদিনের। এবার তাদের জমি দখলের সেই লালিত ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে।
কিন্তু ভারতীয় নাগরিকদের শান্তিতেই কি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে? বাংলাদেশীরা কি তাদের জমির বেদখলকে নীরবে মেনে নেবে? মেনে যে নেবে না তার প্রকাশ তো তারা অনেক দিন ধরেই ঘটিয়ে আসছে। তারা বিক্ষোভ করেছে, মিছিল করেছে, এই ভূমি গ্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ‘আমরা সীমান্তবাসী’ নামে একটি সংগঠনের পতাকাতলে তারা একতাবদ্ধ হয়েছে। যতদূর জেনেছি, এ সংগঠনে কোনো রাজনৈতিক ভেদাভেদ নেই। এখানে আওয়ামী লীগ নেই, বিএনপি নেই। এলাকার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এখানে সবাই একাট্টা। গোপন জরিপ এবং ২৬১ একর জমি ভারতের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে। এক জনসভায় তারা সর্বশক্তি দিয়ে এই প্রক্রিয়া প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলার মাটি যে কবির ভাষায় ‘দুর্জয় ঘাঁটি’ তারই পরিচয় তুলে ধরতে তারা বদ্ধপরিকর। নিজের দেশের ‘সুচাগ্র মেদিনী’ তারা বিদেশের হাতে তুলে দেবে না।
সরকার এখনও নির্বিকার। এই বিষয়টির ব্যাপারে তারা অবলম্বন করে রয়েছে বিস্ময়কর মৌনতা। যেমন তারা বিভিন্ন মহলের দাবি সত্ত্বেও মুখ খুলছে না ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর আসন্ন সফরকালে স্বাক্ষরের জন্য প্রণীত ট্রানজিট চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে। কার স্বার্থে কাদের কল্যাণে সরকারের এই মৌনতা? এ কথা তো আর গোপন নেই যে বাংলাদেশের বুক চিরে ভারত তার দেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাতায়াতের জন্য ট্রানজিট নামধারী করিডোরের সুবিধা লাভ করতে চলেছে। এ কথাও আর গোপন নেই যে, জৈন্তাপুর-পদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ২৬১ একর জমি ভারত পেতে চলেছে। শুধু গোপন থাকছে এ সবের বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে সেই কথাটি। সর্বত্র একটি সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশ আদৌ কিছু পাচ্ছে কি?
সিলেটের জৈন্তাপুর-পদুয়া সীমান্তে জরিপ চালানো হয়েছে। উদ্দেশ্য সহজবোধ্য, এখানে নতুন করে সীমানা নির্ধারিত হবে। সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি অবশ্যই জরুরি। তবে শুধু জৈন্তাপুরে কেন, সারা দেশের সীমানাই তো পুনঃনির্ধারিত হওয়া উচিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা তো ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত কৃত্রিম। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশে বিরাজিত রাজনীতির স্বার্থে র্যাডক্লিফ সাহেব তার কলমের খোঁচায় পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তত্কালীন পূর্ববাংলার সীমানা যেভাবে এঁকে দিয়েছিলেন সেই সীমানা নিয়েই আজ দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অংশ সেদিনের পূর্ববাংলার সীমান্ত কেমন দাঁড়াল তা নিয়ে পাকিস্তানি নেতাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। তারা ব্যস্ত ছিল পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ অর্থাত্ পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। এমনকি মুসলিম প্রধান (হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্বই তো ছিল ভারত-বিভাগের ভিত্তি, যে ভিত্তির ওপর আজ দাঁড়িয়ে আছে ভারত থেকে বিভাজিত হওয়া আর এক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ) কলকাতার ওপর থেকেও তারা দাবি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিল। ফলে র্যাডক্লিফ সাহেব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় পূর্ববাংলার যে সীমানা এঁকেছিলেন ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা ছিল অচল, কৃত্রিম এবং অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের সীমানা নির্ধারণে কারও গ্রাম দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, কারও জমি-বাড়ি, পুকুর-দীঘি, দ্বিখণ্ডিত হয়েছে অনেক জেলা।
দু’দেশের মধ্যকার সীমানা নির্ধারণে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে প্রাকৃতিক নিদর্শন, নদী, পাহাড় ইত্যাদি। ভারত ও তদানীন্তন পূর্ববাংলার সীমানা নির্ধারণে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কিন্তু আজ যখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয় নিয়ে ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তখন দু’দেশের মধ্যকার সীমানাও সেই মর্যাদার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। আজ যখন সীমানা পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে কথা হচ্ছে তখন শুধু জৈন্তাপুর কেন, সারা দেশে যেখানে যেখানেই অসংলগ্নতা বা অসম্পূর্ণতা রয়েছে সে সবখানেই এই উদ্যোগ নেয়া অবশ্য বাঞ্ছনীয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন