পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১১

জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত

সুপ্রিমকোর্টে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আইনজীবীরা পিছু হটলেন। হাইকোর্টে হট্টগোলের ঘটনায় তাদের ১৩ আইনজীবী নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ এবং হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৩ আইনজীবীকে জামিন না দিলে আন্দোলনের যে ঘোষণা এর আগে জাতীয়তাবাদী আইনজীবীরা দিয়েছিলেন, সে অবস্থানে এখন আর তারা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয়তাবাদী আদর্শের আইনজীবীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এবং সেদিনের হট্টগোলের ঘটনাটি সঠিকভাবে সুরাহা করতে না পারার কারণেই তাদের এই পিছু হটা। তবে সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিষয়টির একটি সম্মানজনক সমাধানের দিকে আমরা গিয়েছি। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের পরামর্শে আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং বিষয়টি সম্মানজনক সমাধানের দিকে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে সমঝোতার পর গতকাল সিদ্ধান্ত হয় যে, হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে হট্টগোলের ঘটনায় পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। আত্মসমর্পণের পর বিচারিক আদালত থেকে এসে তারা হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে দুঃখ প্রকাশ করবেন। সমঝোতার পর একথা জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তারা জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির পরামর্শের আলোকে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা সমঝোতার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই ঘটনায় ১৪ আইনজীবীকে আসামি করে মামলা দায়েরের পর অ্যাডভোকেট আসিফা আশরাফি পাপিয়া এমপিসহ তিন আইনজীবীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বুধবার রাতে গ্রেফতার করা হয় এমইউ আহমদ নামে অপর এক আইনজীবীকে। তিনি সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতনে তিনি এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিত্সাধীন।
এদিকে নিম্ন আদালতে গতকাল অ্যাডভোকেট সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়াসহ তিন আইনজীবীর জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হরতালে গাড়ি পোড়ানোর নতুন মামলায় আবারও তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানিয়েছে সরকারপক্ষ।
গতকাল উভয়পক্ষের সমঝোতা বৈঠকশেষে বার সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে হট্টগোলের দুই মামলায় গ্রেফতার না হওয়া আইনজীবীরা আগামী ১৪ আগস্ট নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা বলে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি ১৪ আগস্টের আগে আর কাউকে গ্রেফতার করা হবে না, রিমান্ডে নেয়া হবে না। তাদের নতুন কোনো মামলায়ও জড়ানো হবে না। বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন হওয়ার আশা প্রকাশ করে বার সভাপতি বলেন, আত্মসমর্পণের পর আশা করি আমরা জামিনেও মুক্তি পাব। ওইদিনই আদালত অবমাননার রুলের বিবাদীদের হাইকোর্টে নিয়ে আসব।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, বার সভাপতির সঙ্গে কথা হয়েছে আইনজীবীরা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। এরপর তারা সেখান থেকে এসে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, যারা আদালতের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন, তারা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেতে পারেন না। তাদের অবশ্যই নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। এরপর তারা যাতে পুলিশের হাতে নির্যাতিত না হন, সে বিষয়টি আমরা সবাই মিলে নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।
আপিল বিভাগে শুনানি স্থগিত : বিএনপি সমর্থক ১৩ আইনজীবীকে পেশা থেকে বিরত থাকতে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিতের জন্য করা আবেদনের শুনানি ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। গতকাল প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আট বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ সময় পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে আবেদনকারীদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আইনজীবীদের সনদ স্থগিত সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আপিল বিভাগে গিয়েছিলাম। প্রধান বিচারপতি বললেন, এটা আপনারা নিজেরাই সমাধান করতে পারেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি আইনজীবীদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। ওই ঘটনায় করা মামলায় অপর আসামি যারা বাইরে রয়েছেন, তারা ১৪ আগস্ট বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। এরপর তাদের রিমান্ডে দেয়া হবে না, এমনকি অন্য মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হবে না বলে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বলেন, ১৪ তারিখ আইনজীবীরা আত্মসমর্পণ করে ওইদিন জামিনের আবেদন করা হবে। এ ঘটনায় কারাগারে যারা আটক রয়েছেন, তারাসহ সব আইনজীবী জামিন পেলে ওইদিনই হাইকোর্টে হাজির হতে পারেন বলে তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, ২ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনার পরদিন ওই বেঞ্চ ১৩ আইনজীবীকে তাদের আইন পেশা পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের ব্যক্তিগত মামলা ছাড়া দেশের যে কোনো আদালতে তাদের প্রবেশ না করতেও বলা হয়। হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে ৩ আগস্ট হলফনামার অনুমতি প্রার্থনা করে আপিল বিভাগে আবেদন জানান। এ আবেদনটি বুধবার দুপুরে চেম্বার বিচারপতির আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আদালত বিষয়টি শুনানির জন্য নিয়মিত বেঞ্চে পাঠালে গতকাল প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আট বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তা মুলতবি করেন।
পাপিয়াসহ তিন আইনজীবীর জামিন নামঞ্জুর : আদালতে হাতাহাতি ও পুলিশের কাজে বাধার মামলায় গ্রেফতার হওয়া তিন আইনজীবীর রিমান্ড বাতিল ও জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে গত ১২ জুন হরতালে ধানমন্ডি এলাকায় গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তিন আইনজীবীকে ১০ দিনের রিমান্ড বাতিল করে জামিন দিয়েছেন আদালত। আর নতুন করে শাহবাগ থানার অপর একটি গাড়ি পোড়ানো মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং নতুন করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৬ আগস্ট ওই মামলার রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম মো. শাহাদাত হোসেন হাইকোর্টের এজলাসে হাতাহাতির মামলায় রাষ্ট্র্রপক্ষের রিমান্ড আবেদন এবং আসামিপক্ষের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া গতকাল সকালে তাদের ধানমন্ডি থানায় দায়ের হওয়া বিগত ১২ জুন হরতালে গাড়ি ভাংচুরের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। পরে মহানগর হাকিম শামীমা পারভীন ওই তিন আইনজীবীর রিমান্ড বাতিল করে জামিন দেন।
গতকাল মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তিন আইনজীবী সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, তৌহিদুল ইসলাম এবং আবু বকর সিদ্দিক রাজনকে আদালতে হাজির করা হয়। গ্রেফতারের পর শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক এমএ জলিল তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলেন। আদালতে রিমান্ড শুনানিকালে রিমান্ডের সপক্ষে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আলম তালুকদার। এসময় আসামিপক্ষে রিমান্ড বাতিল করে জামিন চেয়ে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ইকবাল হোসেন, গোলাম মোস্তফা খান, খন্দকার দিদারুল ইসলাম, ওমর ফারুক ফারুকী, মোসলেহ উদ্দিন জসিম, তরিকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান তপন, মোস্তাফিজুর রহমান, নেহায়েল হোসেন ফারুক প্রমুখ আইনজীবী। তারা বলেন, শুধু রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এ মামলায় তাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শুনানির একপর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার দিদারুল ইসলাম বলেন, সুপ্রিমকোর্টের দরজায় যারা একসময় লাথি মেরেছেন, প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুর করেছেন এবং আইনজীবীদের গাড়িতে আগুন দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন পুরস্কৃত হয়ে বিচারপতি হয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া আইনজীবীরা আদালতে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করেননি। বরং সেখানে সরকার সমর্থক আইনজীবীরা শুনানিতে বাধা সৃষ্টি করেছেন। অথচ পুলিশ উল্টো বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন