এতদিন আমরা ‘পুকুর চুরি’র কথা জানতাম। বইপত্রে এমনটাই লেখে। দিন বদল হয়ে গেছে। ওই অভিধা এখন ব্যাক ডেটেড। অভিধানেও সংশোধনী আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এখন চলছে সংশোধনীর তুফান। পুকুর বা পুষ্করিণী তো মামুলি ব্যাপার। ক্ষুদ্র জলাধার। অজস্র পুকুর যেখানটায় চুরি হয়, তাকে কী বলব আমরা। অনেক পুকুর মিলে মিলে সমুদ্র হয়ে যায়। ক্ষুদ্র বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। সমুদ্র চুরিই বলব।
খবর এসেছে চট্টগ্রাম থেকে। সেখানে সমুদ্র আছে। বছরে ওখানে দেড় হাজার কোটি টাকার বিদ্যুত্ চুরি যাচ্ছে। জড়িত পিডিবি’র হর্তাকর্তারাই। প্রতিদিন ৭০ মেগাওয়াটের কোনো হিসাব নেই। টেকনিকটা মজাদার। ইচ্ছাকৃতভাবে লোডশেডিং সঙ্কট বজায় রেখে চুরি করা বিদ্যুত্ বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে গোপনে বেচে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এই গোপন বাণিজ্য অব্যাহত রাখার স্বার্থে তিনটি বিদ্যুত্ কেন্দ্রের উত্পাদনও সব সময় কম রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিদ্যুত্ বিতরণে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার এই গোপন বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে সম্প্রতি।
বেশ হয়েছে। গোপন কলাকৌশল চলে এসেছে প্রকাশ্যে। এই মডেল অন্য জেলায়ও অনুসৃত হতে পারবে। আমরা অত্যন্ত দেশপ্রেমিক (!), কামিয়াব, বিরল প্রতিভার অধিকারী পিডিবি’র হর্তাকর্তাদের আরো আরো সাফল্য কামনা করি। তাদের মহাপ্রতিভা আরো বিকশিত হয়ে উঠুক, তারা সমাজে, দেশে নমস্য ব্যক্তি হয়ে উঠুন, সেই দুর্লভ দৃশ্য দেখবার গোপন খায়েশ মনে মনে লালন করি। তাদের প্রতিভার আলোকরশ্মি লন্ডনের দাঙ্গার মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক। তারা ঠিক কাজটি করেছেন। কথায় বলে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আরে ভাই, নিজেদের পকেটই যদি থাকে মঙ্গাকবলিত, তখন আপনি দেশপ্রেম ধুয়ে কি পানি খাবেন? পকেট ভালো তো মেজাজ-মর্জিও ভালো, ফুরফুরে।
বিদ্যুত্ নিয়ে বাঙালিরা বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। ঝাড়ু মিছিল করছে। পোলাপান, বুড়া-জোয়ান, আণ্ডাবাচ্চা সবাই নেমে পড়ছে রাজপথে। যেন মহা একটা অ্যাডভেঞ্চারিজম। প্রবল উত্সাহে তারা বিদ্যুত্ কেন্দ্র ঘেরাও করছে। অবরোধ করে রাখছে মহাব্যস্ত মহাসড়ক। জনজীবনের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করছে। পাবলিককে ভোগাচ্ছে। রাস্তায় চলাচলকারী পাবলিক তো বিদ্যুত্ ডিপার্টমেন্টে কাজবাজ করে না। তাদের ভোগান্তিতে ফেলার কোনো অধিকার কি বিদ্যুত্বঞ্চিত ক্ষিপ্ত আমজনতার আছে? নাই। তারা হেনস্তা করছে কর্মকর্তাদের। যারা এই সঙ্কটের জন্যে দায়ী, তাদের শাপ-শাপান্ত করছে। সে এক অরাজক অবস্থা। আমরা এ ধরনের সমাজবিরোধী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে পারি না। কিছুতেই না। বিদ্যুত্ কর্মকর্তারা জান কোরবান করে দিচ্ছেন। তাদের এই যে ঘামঝরানো কোশেশ, তার মিনিমাম প্রশংসা না করে উল্টো তাদের চোর দায়ে দায়ী করা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে তাদের নিন্দা অপবাদ লানত সইতে হচ্ছে। এটা অন্যায়। ভারি অন্যায়।
আমরা বিদ্যুত্ ‘কম কম’ ব্যবহারের সুপারিশ করব। কম খাওয়া থিয়োরি সম্প্রতি মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। সেটাও আরেক অনাচার। কোনো ভালো পরামর্শ বাঙালি নিতে জানে না। কম বিদ্যুত্ খরচা করলে নিজের লাভ, দেশের লাভ। বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে পারলে আরো ভালো। আর বিদ্যুতের এত দরকারই বা কী? অর্থাত্ বিদ্যুেক তালাক দিয়ে দিতে পারলেই হয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা কি বিদ্যুিবহীন জীবনযাপন করে যাননি? গেছেন। তাদের জীবনে তো এত অসন্তোষ, এত ক্যাচাল ছিল বলে শুনিনি। বিদ্যুত্ থাকলেই বরং ঝামেলা। শহরে শহরে শপিং মলে চোখ ধাঁধানো আলোকচ্ছটা, বিয়ের অনুষ্ঠানে বিদ্যুত্ খরচার মচ্ছব লেগে যায়। গাঁয়ে-গঞ্জে গভীর রাত্রি পর্যন্ত আড্ডাবাজি চলে, এটা জাতীয় সম্পদের নিদারুণ অপচয়। ইফতার-সাহরি, তারাবি নামাজের সময় লোডশেডিং না করতে বলা হয়েছে বিদ্যুত্ বিভাগকে। কিন্তু তারা যে রাম বয়রা। কোনো কিছুই তাদের কানে পশে না। দশাসই সাইজের মুগুরের বিধিব্যবস্থা করতে পারলে অবশ্য এ সমস্যার একটা হিল্লে হলেও হতে পারে। সেটা করবে কে? হু উইল বেল দ্য ক্যাট। বিদ্যুত্-ডাকাতরা থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেমন বেণী, তেমনি রবে চুল, ভিজাবে না। শুধুই কি বয়রা তারা? না। চামড়াও গণ্ডারের। সুতরাং যত হাঁকডাকই করা হোক না কেন, কিছুতেই কিছু হবে না।
চট্টগ্রামে পিডিবি’র যে কর্মকর্তাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে সমুদ্র চুরির এই আইডিয়া বেরিয়েছে, তারা প্রাতঃস্মরণীয়। রাতে তো লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় মানুষের চান্দি গরম থাকে। কোনো শুভ চিন্তার জন্যে বিদ্যুত্হীন পরিবেশ অনুকূল নয়। সেজন্যে তারা নৈশ-স্মরণীয় হতে পারছেন না। এটা তাদের কপালের ফেরই বলতে হবে।
বিদ্যুত্-খাত থেকে সমুদ্র চুরি করে পিডিবি’র তালেবর কর্মকর্তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। তাদের ধরে কার সাধ্য? ছিঁচকে, ছিনতাইকারীরা নির্মম গণপিটুনিতে পটল তোলে। তাদের অপরাধ সামান্য, কিন্তু গুনতে হয় চরম মাশুল। জানই দিয়ে দিতে হয়। আর এসব উচ্চশিক্ষিত, সফিস্টিকেটেড হোমরাচোমরাদের কিছু হয় না। তারা অতিশয় সেয়ানা, কোনো ফাঁকফোকর তারা রাখতে চান না। সমুদ্র চুরি করেই তারা টিকে থাকেন বহাল তবিয়তে। তাদেরকে আমরা ঈর্ষা করি না। আমাদের মন এতো ছোট নয়। আমরা চাই তাদের পকেট আরো স্ফীত হোক, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়ুক। তাদের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন