আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশীকে চাকরি হারিয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরতে হবে। আকামা বা ওয়ার্ক পারমিটসহ আইনগত জটিলতা এমন অবস্থার প্রধান কারণ। দৈনিক আমার দেশ-এর সরেজমিন রিপোর্টে জানানো হয়েছে, চার বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি আরবে বাংলাদেশীদের আকামা নবায়ন বন্ধ রয়েছে। বেশি বেতনের ভালো চাকরি পেলেও আকামা পরিবর্তন করা যাচ্ছে না বলে বাংলাদেশীরা সুযোগ নিতে পারছে না। কয়েক লাখ বাংলাদেশীকে এরই মধ্যে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেককে জেলে ঢুকিয়েছে সৌদি সরকার, বাকিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এদেরই ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। আকামাই অবশ্য একমাত্র কারণ নয়। অন্য দুটি বিশেষ কারণের একটি ভারতের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার, অন্যটি সরকারের ব্যর্থতা। সৌদি আরবের চাকরিতে বাংলাদেশের সঙ্গে বহু বছর ধরেই ভারতের তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের ২৪ শতাংশের পিছু পিছু ১৮ শতাংশ চাকরি পেয়েছিল ভারতীয়রা। কিন্তু সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেশি চাকরি পাওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে ভারত বাংলাদেশীদের তাড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। জনশক্তি রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ভারত সরকারও ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে। ঘুষ এবং সৌদি পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে তারা। সৌদি মিডিয়ায় বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগ এনে সর্বাত্মক প্রচারণা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশীদের ‘কাতিলা মুশকিলা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তারা। মূলত ভারতীয়দের ষড়যন্ত্রেই বাংলাদেশীদের ‘আকামা’ বাতিল করেছে সৌদি মালিকরা। সৌদি আরবে চাকরি পাওয়ার দরজাও তখনই বন্ধ হতে শুরু করেছিল।
অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে প্রতিকারের কোনো চেষ্টাই কিন্তু লক্ষ্যযোগ্য হয়নি। একটি ব্যাংক বিক্রির ব্যাপারে সৌদি বাদশাহর ভ্রাতৃবধূর সঙ্গে প্রতারণা করায় প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ চেষ্টা করেও সৌদি আরবে সরকারি সফরে যাওয়ার সুযোগ পাননি। জনগণের টাকায় বিশ্ব ভ্রমণের রেকর্ড সৃষ্টিকারী পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও কখনও সৌদি আরবে যেতে পারেননি। রাজনৈতিক কারণও তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশে ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ওই সরকারের নেয়া পদক্ষেপ সৌদি সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু কার্যক্রম পরিস্থিতিকে বরং আরও জটিল করেছে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নামে বাড়াবাড়ি এবং ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে দমনমূলক অভিযানকে সুনজরে দেখেনি সৌদি সরকার। তা সত্ত্বেও ২০০৯ সালের এপ্রিলে দেশটি সফরের সুযোগ পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এই সফর নিয়ে, বিশেষ করে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি মিথ্যাচার করেছিলেন। ঘোষণার ঢঙে বলেছিলেন, সৌদি বাদশাহ নাকি শেখ হাসিনাকে ‘বোন’ ডেকেছেন! সৌদি আরবে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলেও দাবি করেছিলেন দীপুমনি। এটাও ছিল চরম মিথ্যাচার। প্রমাণিত ইহুদি কানেকশনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কোনো সফরসঙ্গীর ব্যাপারেও আপত্তি ছিল সৌদি সরকারের। সব মিলিয়েই সৌদি সরকার বাংলাদেশের প্রশ্নে নেয়া সিদ্ধান্তে পরিবর্তন ঘটায়নি। ফলে শেখ হাসিনার সফর-উত্তর দিনগুলোতেও দেশটিতে বাংলাদেশীদের বিপদ বেড়েছে। এবার তাড়া খেয়ে ফিরতে হচ্ছে ১০ লাখ বাংলাদেশীকে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক দেশেই আমাদের জনশক্তি রফতানি হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয় তো পরিমাণ নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। কোনো কোনো দেশের রাজনৈতিক পালাবদলেরও শিকার হয়েছে বাংলাদেশীরা। অর্থাত্ বিদেশে বাংলাদেশের জন্য চাকরির বাজার একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। অথচ বিশ্বব্যাপী তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও প্রবাসীরাই এখনও বৈদেশিক মুদ্রার বড় একটি অংশের জোগান দিয়ে চলেছেন। এতদিন সবচেয়ে বেশি তথা মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৩৫ শতাংশই এসেছে সৌদি আরব থেকে। সবচেয়ে বড় সেই চাকরির বাজারেই বাংলাদেশীদের জন্য চাকরির দরজা বন্ধ হই হই করছে। সংখ্যাও গত চার বছরে ২২ লাখ থেকে কমে এসেছে ১৮ লাখে। আরও ১০ লাখ ফেরত এলে বাকি থাকবে কতজন, দীপুমনি আর মুহিত সাহেবরা সে হিসাব কষে দেখতে পারেন। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, দিন আসছে যখন কারও কারও ঠোঁটের বাঁকা হাসি তো মিলিয়ে যাবেই, প্রধানমন্ত্রীও চোখে শুধু ‘সরষের ফুল’ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না। এজন্যই সরকারের উচিত ভারতের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা চালানো। সে চেষ্টায় তাই বলে এমন কাউকে যুক্ত রাখা চলবে না যিনি মুসলিম বিশ্বের নেতারাষ্ট্র সৌদি আরবকে বিশেষ সম্মান দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মতো স্কার্ফ পরা দূরে থাকুক, দাদি-নানিদের মতো মাথায় ঘোমটা পর্যন্ত দেন না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন