পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি তীব্র সংঘাতময় ও অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত শুক্রবার সকালে কাপ্তাই উপজেলার চিত্মরম ইউনিয়নের আগাপাড়া গ্রামে ইউপিডিএফের সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপের ব্রাশ ফায়ারে দুই গ্রামবাসী ও এক জেএসএস কর্মী নিহত হওয়ার পর শান্তিচুক্তি সমর্থিত ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস, সন্তু বিরোধী সংস্কারপন্থী জেএসএস এবং চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। শুক্রবার সারারাত কাপ্তাইয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। রাতের গোলাগুলিতে কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউনিয়নের ভাল্লুকিয়া গ্রামে আরও তিন ইউপিডিএফ সদস্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি।
কাপ্তাইয়ে সেনা ক্যাম্প থাকাকালীন উপজাতীয় ক্যাডাররা এত বেপরোয়া হওয়ার সাহস পেত না বলে স্থানীয়রা দাবি করেন। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় সেনা সদস্য বিজিবি জওয়ানদের সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কায় লোকজন অন্যত্র সরে যাচ্ছে।
গতকাল কাপ্তাইয়ের চিত্মরম ও রাইখালী ইউনিয়নের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে ব্রাশ ফায়ারে জেএসএসকর্মীসহ তিনজন নিহত হওয়ার পর এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জেএসএস। কাপ্তাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা সংঘটিত হয়। কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউপি চেয়ারম্যান অংসি মারমা জানান, তার ইউনিয়নের আওতাধীন ভাল্লুকিয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। রাতভর এই গোলাগুলি চলে। সকালে এসব গোলাগুলির ঘটনায় তিন ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়নি।
কাপ্তাই ৭ আরই ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক ও কাপ্তাই জোন কমান্ডার লে. কর্নেল ইলিয়াস হোসেন পিএসসি ইঞ্জিনিয়ার্স গতকাল এ প্রতিনিধিকে জানান, কাপ্তাই হত্যাকাণ্ডের পর এলাকার পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ রয়েছে।
কাপ্তাই জোন কমান্ডার ইলিয়াস হোসেন জানান, উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে গতকাল ভোররাত থেকে রাইখালী ভাল্লুকিয়া এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। কাপ্তাই জোনের আওতাধীন রাজস্থলী, বাঙ্গালহালিয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সেনা টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই জানান, পাহাড়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখে এলাকা ছেড়ে অনেক সাধারণ মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। কাপ্তাইয়ে তিন হত্যাকাণ্ডের পর কাপ্তাই রাজস্থলী চন্দ্রঘোনা রাঙামাটিতে পার্বত্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী সূত্র জানায়, কাপ্তাইসহ রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় জেএসএস ও ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে গত এক বছরে কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবারের তিনজনসহ কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলায় ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে ৯ জন। পাহাড়ে এখন নতুন করে অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে গেছে। ইউপিডিএফ ও জেএসএস উভয়েই এখন অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, গত এক বছরে তিন পার্বত্য জেলায় দুই গ্রুপ শতাধিকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা শত শত রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছে। কিন্তু সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ দুই গ্রুপের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। কাপ্তাইয়ের স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, কাপ্তাইয়ে ৬৫ পদাতিক সেনাবাহিনীর ব্রিগেড থাকাকালীন পাহাড়ি সংগঠনগুলোর ক্যাডাররা এত বেপরোয়া ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকার কাপ্তাই থেকে ৬৫ পদাতিক ব্রিগেড প্রত্যাহার করার পর এখানে সংঘাত-সংঘর্ষ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধ ও গেরিলা হামলায় অতর্কিত ব্রাশ ফায়ারে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস ও ইউপিডিএফ টোকেন কিংবা রসিদ দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা কেউই তাদের চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তবে স্থানীয় কাঠ-বাঁশ ব্যবসায়ীরা এদের চাঁদাবাজির বেশি শিকার। এমন অভিযোগ এ অঞ্চলের সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিসহ সব সাধারণ নাগরিকের। একসময় সন্তু লারমা ছিলেন শান্তি বাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি আর প্রসীত খীসা ছিলেন ওই সংগঠনের অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৭ সালে প্রসীতের নেতৃত্বে জন্ম হয় ইউপিডিএফ নামের আলাদা সংগঠন। যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর জেএসএস ও ইউপিডিএফের আধিপত্যের লড়াইয়ে এ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক লোক হতাহত হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি কমেনি, ক্ষেত্র বিশেষ বেড়েছে।
ইউপিডিএফ ও জেএসএসের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা জানান, শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিডিএফের জন্ম হলেও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তারা পাহাড়ে অনেক এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় তাদের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। জেলার বড়কল, নানিয়ারচর কাউখালীতে তাদের প্রভাব বেশি। খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, লক্ষ্মীছড়িতে ইউপিডিএফ এরই মধ্যে তাদর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা থেকে সব কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে জানা গেছে। তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের ‘ড্রাগন’ ও ‘কোবরা’ বলে পরিচিতি রয়েছে। মূলত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ড্রাগন ও কোবরা কর্মীদের মাধ্যমে রাঙামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের কিছু অঞ্চলে তারা ‘সমান্তরাল’ প্রশাসন তৈরি করেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কর্মীরা অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। এদের ওপর ভর করে ইউপিডিএফ নিজস্ব বিচারব্যবস্থা কায়েম করেছে। সংগঠনটি এখন কৌশলে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও ছড়াচ্ছে। নানা কায়দায় অবৈধ অস্ত্র সংগহ করে তরুণদের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন দেখিয়ে দলে ভিড়িয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ তরুণদের দিয়ে গণহারে চাঁদা আদায় করছে। পাশাপাশি সন্তু লারমার সমর্থিত জেএসএস ও সন্তু বিরোধী সংস্কারপন্থী জেএসএসও নিজেদের চাঁদাবাজির আদিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং সংস্কারপন্থীদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে কাপ্তাইয়ের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে গতকাল কাপ্তাই ৪ ওয়াগ্গা বিজিবি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আকতার শহীদ পিএসসি জানান, বিজিবি জোনের আওতাধীন কাপ্তাইয়ের চিত্মরম, রাইখালী, ভাল্লুকিয়াসহ সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় বিজিবি জওয়ানরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন