মহাজোট সরকারের বদৌলতে চালও এখন সোনা হতে চলেছে। চাল বহনকারী সব ট্রাকে এখন থেকে পুলিশের পাহারা থাকবে। সামনে ও পেছনে রীতিমত পুলিশের ‘এসকর্ট’ দিয়ে চালের ট্রাক পাহারা দেয়া হবে—যেমনটি মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সিদ্ধান্তটি নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পণ্যবাহী ট্রাক পরিবহনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। বলাই বাহুল্য, সেখানে সভাপতির আসনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া আর কারও চান্স পাওয়ার কথা নয়। পানওনি। কমিটির সিদ্ধান্তগুলোও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। যেমন সড়ক-মহাসড়কে পুলিশ এসকর্টের ব্যাপারে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের ডিআইজিরা। যখন যে জেলায় থাকবে তখন সে জেলার পুলিশ ট্রাকের নিরাপত্তা বিধান করবে। উল্লেখ্য, বিশেষ করে নওগাঁ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারী ট্রাকে ডাকাতি সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। চালক ও হেলপারদের হত্যাও করেছে ডাকাতরা। এসব কারণেই সরকারের এসকর্ট তত্পরতা।
এ ধরনের সিদ্ধান্তের খবর শুনে মানুষ ভাবতেই পারে যে, এতদিন সোনালি আঁশের তথা পাটের কথা শোনা গেছে। মহাজোট সরকারের কল্যাণে এবার চালও সোনা হয়ে উঠল বলে! অন্যদিকে এসকর্টের খবরটি কিন্তু আশ্বস্ত করার পরিবর্তে জনগণকে উল্টো ভীত-সন্ত্রস্ত করেছে। এটা অবশ্যই সরকারের যোগ্যতা প্রমাণ করে না। বাস্তবে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি দেখে বলার উপায় নেই যে, দেশে সত্যি কোনো সরকার রয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীনরা প্রথম থেকে চোখ কম রাঙাচ্ছেন না, ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেয়ার ধমক দেয়া তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ব্যামো’তেই পরিণত হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পরিস্থিতিতে উন্নতি হওয়ার লক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ঘটনাপ্রবাহে বরং অন্য রকম খবর বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, নওগাঁ থেকে ছেড়ে আসা ট্রাকগুলোর চাল ডাকাতরা বিশেষ কিছু এলাকার আড়তে বিক্রি করে দেয়। কেনার এবং পরে বেচার সময় আড়ত্দাররা মুখ ঢেকে রাখারও প্রয়োজন বোধ করে না। বেচাকেনা তারা বুক চিতিয়েই করে। অর্থাত্ সবই রয়েছে পুলিশের নখদর্পণে। আর পুলিশের নখদর্পণে থাকার অর্থ কী হতে পারে—তা নিয়ে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। একই কারণে পুলিশের এসকর্ট সংক্রান্ত খবরে বিশেষ করে চাল ব্যবসায়ী ও ট্রাক মালিকদের এবং চালক ও হেলপারদের মধ্যে খুব একটা উত্সাহের সৃষ্টি হয়নি। এর কারণ, অনেক ঘটা করে এসকর্ট নাম দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেই পুলিশই থাকবে। অন্যকিছু কারণের কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ী এবং মালিক ও শ্রমিকরা। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের সব মহাসড়কেই ব্যাপকভাবে চলছে চাঁদাবাজি। কিন্তু দরখাস্ত করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, চাঁদাবাজি করছে ‘সোনার ছেলেরা’। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারাও ‘ভাগ’ পাচ্ছে বলে পাশ কাটিয়ে চলেছে। মামলার বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, ডাকাতির মামলা হলেও থানায় পুলিশ নথিভুক্ত করছে সাধারণ মামলা হিসেবে। প্রায় ক্ষেত্রে ডাকাতদের পরিবর্তে পুলিশ উল্টো ব্যবসায়ী এবং ট্রাকের মালিক ও শ্রমিকদের পেছনে লেগে পড়ছে—যেন অপরাধ তারাই করেছে!
এসব কারণেই পুলিশকে দিয়ে এসকর্টের ব্যবস্থার কথা শুনে মোটেও আশাবাদী হতে পারেননি ব্যবসায়ী ও ট্রাক মালিকরা। তারা মনে করেন, ডাকাতদের পাশাপাশি প্রথমে ব্যবস্থা নেয়া দরকার দোষী পুলিশের বিরুদ্ধে। কারণ, তারা সব জানে এবং চাইলে ডাকাতি ও চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধই প্রতিহত করতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে হবে অসত্ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে—যারা ডাকাতির চাল কেনাবেচা করে। যেহেতু তারা বুক চিতিয়ে প্রকাশ্যেই করে সেহেতু তাদের খুঁজে বের করাটাও কঠিন কাজ হতে পারে না। একযোগে ব্যবস্থা নেয়া দরকার চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধেও। ‘সোনার ছেলে’ হিসেবে যত আদরেরই হয়ে থাকুক না কেন, অতিষ্ঠ জনগণ কখনও তেড়ে উঠলে কিন্তু ‘খবর’ হয়ে যাবে—‘সোনার ছেলেদের’ কাউকেই তখন সরকারের পাশে দেখা যাবে না। সুতরাং কেবলই ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেয়ার বহুবার দেয়া ধমকের পুনরাবৃত্তি করার এবং পুলিশের এসকর্ট ধরনের রাজকীয় ব্যবস্থার ভরসায় বসে থাকার পরিবর্তে সরকারের উচিত সর্বশক্তি দিয়ে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি বন্ধের বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া। এটা যে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশকে দিয়ে সম্ভব নয় এবং এই পুলিশকে যে ব্যবসায়ী ও ট্রাক মালিকরা বিশ্বাস করেন না—কঠিন এই সত্যের তাত্পর্য এখন পুলিশকেই বিশেষভাবে বোঝানো দরকার। সরকারকেও অনুধাবন করতে হবে, চালের ট্রাক পাহারা দেয়ার জন্য কেবল পুলিশের এসকর্ট সমাধান হতে পারে না। দরকার আসলে সর্বতোভাবে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো এবং এজন্য সময় থাকতে সততার সঙ্গে তত্পর হয়ে ওঠা। না হলে চাল কিন্তু সত্যি সত্যি সোনা হয়ে উঠতে পারে—যার দাম চুকাতে গিয়ে দুর্ভিক্ষে মারা পড়তে হবে পারে ডিজিটাল যুগের কয়েক লাখ মানুষকে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন