পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১১

স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে ভারতীয় অবৈধ ডিশ বক্সের রমরমা বাণিজ্য : বছরে দু’হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে ভারতীয় ডিশ বক্স অবাধে আসছে দেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অবৈধ এসব বক্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। সরকারের অবহেলা, উদাসীনতা আর অদক্ষতায় ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের বাজার ছেয়ে গেছে এসব বক্সে। দিনে দিনে এর বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে এদেশে। বাজার দখল করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এদেশে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। দেশীয় এ সিন্ডিকেট সরকারকে ম্যানেজ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘ডাইরেক্ট টু হোম’ (ডিটিএইচ সার্ভিস) নামের এসব ডিশ বক্সে কেবল ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার হচ্ছে। ওই সার্ভিসে এদেশের কোনো চ্যানেল নেই। ফলে এদেশে ভারতীয় চ্যানেলের আধিপত্য বাড়ছে। এতে দেশীয় সংস্কৃতি পড়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের কবলে। চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজার গড়ে উঠছে এদেশে। এসব বক্স দিয়ে অনেক ক্যাবল ব্যবসায়ী ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার করছেন। আর তারা দেশের সরকারকে কর না দিয়ে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে টাকা দিচ্ছেন। এতে সরকার বছরে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে বলে ক্যাবল অপারেটরদের সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন। বক্সের মধ্যে পর্নো সিনেমা প্রচারের চ্যানেলও আছে। এসব চ্যানেল দেখে নষ্ট হচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্ম।
বাজারের চিত্র : ঢাকাসহ সারাদেশের বাজার সয়লাব আজ ভারতীয় ডিশ বক্সে। ঢাকা থেকে এসব বক্স যাচ্ছে সারাদেশে। বক্সগুলো প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চোখের সামনে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সুপার মার্কেটে গেলে এমন চিত্রই দেখা যায়। সেখানকার ইলেকট্রো, টোকিও, আলিশা ও নবরূপা ইলেকট্রনিক্সসহ প্রায় সব দোকানের সামনে বড় বড় অক্ষরে ঝুলছে এসব বক্স বিক্রির বিজ্ঞাপন। টাটা স্কাই, ডিশ টিভি, সান ডাইরেক্ট, বিগ টিভি, এয়ারটেল ডিজিটাল টিভি, ডিডি ডাইরেক্ট প্লাসসহ ভারতীয় প্রায় পনেরটি কোম্পানির উত্পাদিত ডিশ বক্স সেখানে বিক্রি হচ্ছে। অভিজ্ঞদের মতে, এসব বক্স মূলত ডিশ এন্টেনার আধুনিক সংস্করণ। সস্তা, সহজলভ্য ও ঝামেলাহীন হওয়ায় বাজারে দিন দিনই এর চাহিদা বাড়ছে। প্রতি বক্সে বিশ থেকে ত্রিশটি ভারতীয় চ্যানেল দেখা যায়। একেকটি ডিটিএইচ বক্সের দাম ছয় থেকে দশ হাজার টাকা। একাধিক বিক্রেতা জানান, ভারত থেকে আনতে দাম পড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। অভিজাত এলাকার বাসিন্দা ও ক্যাবল ব্যবসায়ীরা এসব বক্সের ক্রেতা। ক্যাবল অপারেটররাও চ্যানেল সম্প্রচার করছেন বক্সগুলোর মাধ্যমে। আলিশা ইলেকট্রনিক্সের বিক্রেতা করিম আহমেদ জানান, সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতীয় দালালদের মাধ্যমে তারা এসব বক্স আনেন।
দেশেই সিন্ডিকেট : ভারতীয় ডিটিএইচ সার্ভিস ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশেও সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এতে এদেশের সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্যাবল অপারেটরদের সংগঠন ‘স্যাটেলাইট ক্যাবল নেটওয়ার্ক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিনওয়ার) সভাপতি মীর মোসাইন আখতার একথা স্বীকার করেন। অন্য সংগঠন ‘ক্যাবল অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (কোয়াব) সাবেক সভাপতি আনোয়ার পারভেজও বিষয়টি স্বীকার করেন। ডিটিএইচ বক্সে কোম্পানির দেয়া নির্দিষ্ট নম্বরের ফ্রিকোয়েন্সির সাহায্যে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল প্রচার হয়। এজন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলো হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা এদেশে খরচ করছে। এ সংযোগের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা প্রথমে সাড়ে চার হাজার টাকা নিচ্ছেন। মাসিক সাব্সক্রাইবার ফি হিসেবে নেন পাঁচ থেকে ছয়শ’ টাকা। ই-ব্যাকিংয়ের মাধ্যমেও ডিটিএইচ চার্জ পরিশোধ হচ্ছে। মোবাইলের প্রি-পেইড কার্ডের মতো বিভিন্ন মেয়াদের ডিটিএইচ কার্ডও বাজারে আছে। এসব বক্স ব্যবসার বেশিরভাগ টাকা চলে যাচ্ছে ভারতে।
নীরব সরকার : ‘ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী কোনো নাগরিক ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক স্বার্থে ডিশ এন্টেনা ব্যবহার করতে পারেন না। সিনওয়ার’র সভাপতি মীর মোসাইন আখতারের মতে, আইন অনুযায়ী ওই ব্যবসা অবৈধ। তবে তা ঠেকাতে সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও এক্ষেত্রে নীরব। এ প্রসঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করেও তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য জানা যায়নি। তথ্য সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুন বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। সীমান্ত দিয়ে এসব বক্স আসা ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কোনো তত্পরতা নেই। ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নেই কোনো তত্পরতা। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য জানতে গতকাল কয়েকবার তার মুঠোফোন নম্বরে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। মীর মোসাইন আখতার দাবি করেন, ‘বিষয়টি আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে একাধিকবার। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের দাবিও বলেছি। তবে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম দেখছি না’।
ফিরে দেখা : প্রয়াত অভিনেতা সোহেল চৌধুরী নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকার গুলশান-১ এলাকায় ‘ফ্রেন্ডস ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক’ নামে তিনি অবৈধভাবে তা শুরু করেন। তিনি ও তার সহযোগীরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলের পেমেন্ট পাঠাতেন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকা শহরে ব্যবসাটি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ছড়ায় সারাদেশে। ওই ক্যাবল ব্যবসার বর্তমান সংস্করন হচ্ছে ‘ডিটিএইচ সার্ভিস’। প্রথম থেকেই ক্যাবল ব্যবসাখাতে রাজস্ব হারায় সরকার। সোহেল চৌধুরী আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে ঢাকার এক ক্লাবে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর এ ব্যবসা থেমে থাকেনি। ক্ষমতায় যারা আসেন, তাদের সহয়তায় চলে এ ব্যবসা। সরকারের উদাসীনতায় দিনে দিনে এর বিস্তার ঘটে জোরালোভাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন