‘ভেতরের-বাইরের লুটেরারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশকে লুট করছে’ অভিযোগ করে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু বলেছেন, দেশটা লুট হয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য দেশকে একটি অঘোষিত কারাগার তৈরির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে লুটেরাদের হাত থেকে দেশ রক্ষায় গণঐক্য ও গণআন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
শেখ শওকত হোসেন নিলু গতকাল কাকরাইলের দলীয় কার্যালয়ে দৈনিক আমার দেশকে দেয়া একান্ত সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন।
তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি এবং ট্রানজিট ও করিডোর প্রদান, পঞ্চদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, আদালতে দলীয়করণ, গ্যাস-বিদ্যুত্-পানি সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিরোধী দল দমনে সরকারের কর্মকাণ্ড, গণমাধ্যমের ওপর খড়্গসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারকে গণবিরোধী অভিহিত করে সরকারের পতন আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে তিনি গণতান্ত্রিক সব শক্তির প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যে বুঝে গেছে দেশের জনগণ তাদের চায় না। আগামীতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা জনস্রোতের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। আর এজন্যই সুষ্ঠু নির্বাচনের সব পথ রুদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েমের পথে ছুটছে তারা। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পেছনে ‘পুনঃক্ষমতা প্রাপ্তির ষড়যন্ত্র’ই মূল কারণ উল্লেখ করে এনপিপি চেয়ারম্যান বলেন, কোনো স্বাভাবিক নির্বাচনে এ সরকার ক্ষমতায় আসেনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একটি নির্বাচনী মহড়া। গোপন চুক্তির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আর এখন ওই গোপন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অসংখ্য গোপন চুক্তি করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য এবং বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিস্টের সংবাদ সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছে। দেশের জনগণের সন্দেহই তারা প্রকাশ্যে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। ভারতের কাছ থেকে বস্তাভরা টাকা এনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন প্রসঙ্গে শেখ শওকত হোসেন নিলু বলেন, অস্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় আসা সরকার দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার কথা বলা হলেও তা তারা করেনি। কেননা তা করলে দেশে প্রত্যক্ষ বাকশাল কায়েম হয়ে যেত। তারা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের আবরণে পরোক্ষ বাকশাল কায়েম করেছে। এই সংশোধনী মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এখন দেশে সমাবেশ করার অধিকার নেই, জায়গা নেই। পরিকল্পিতভাবে সব গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ করার স্থানকে নামে-বেনামে দখল করা হচ্ছে। মুক্তাঙ্গনের মতো জায়গায়ও এখন সমাবেশ হতে দিচ্ছে না। সরকারদলীয় সংগঠন ছাড়া কাউকে অনুমতি দিচ্ছে না পুলিশ। তিনি বলেন, এ সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে। সংবাদপত্রগুলো বন্ধ না করলেও একটি-দুটিকে বন্ধ করে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। সম্পাদকদের হাতকড়া লাগিয়ে আদালতে নেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ ঘটনা গণতন্ত্রকে হাতকড়া লাগানোর শামিল। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের রুগ্ন গণতন্ত্রকে কবরের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ঢাকা সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি অভিযোগ করে এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু বলেন, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ না হলে সম্পর্কের উন্নতির স্লোগান দিয়ে কোনো লাভ নেই। ফেলানীর বাবা-মায়ের চোখের পানি ভালো সম্পর্কের চিহ্ন নয়। এদেশের মা-বাবা, ভাই-বোনের মুখে হাসি থাকলে এবং ভারতীয় সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়া নিশ্চিত করতে পারলে সেটা সম্পর্ক উন্নতির প্রতীক হতে পারে। মনমোহন সিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরে কোনো গোপন চুক্তি না করে দেশের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি হলে তা সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে। অন্যথায় কোনো গোপন চুক্তি এদেশের জনগণ মানে না। গোপন চুক্তি জনগণ বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মনমোহন সিংয়ের আসন্ন সফরে যে চুক্তি হবে, তা জাতির জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হবে। এজন্য তিনি চুক্তি করার আগে জাতীয় সংসদে সব দলের সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে চুক্তির বিষয়ে আলোচনা এবং সব রাজনৈতিক দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুক্ত সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানান।
ট্রানজিট ও করিডোর বাংলাদেশের মানুষের ললাটে এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসন হিসেবে আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইন-আদালত, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় ইতোমধ্যে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। করিডোর সবকিছু দখল করে নেয়ার একটি পথ খুলে দেবে। বন্দর, শিল্প-কারখানাসহ সবকিছুতে নেপালের মতো প্রভাব বিস্তার করে নেবে ভারত।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করে এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ নিলু বলেন, জনগণের সঙ্গে রঙ্গরহস্য করছে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। প্রধানমন্ত্রীও এক্ষেত্রে দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি কেবল বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও মামলা-নির্যাতনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এভাবে একটি সরকার চলতে পারে না। নিজেদের পাতা ফাঁদেই এ সরকারের মৃত্যু ঘটবে। পানি-গ্যাস-বিদ্যুত্ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের ব্যর্থতাকে পরিকল্পিত অভিহিত করে এনপিপি চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ, বাণিজ্য, জ্বালানি, পানিসম্পদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপদেষ্টার কার্যক্রমে মনে হয় তারা বাংলাদেশের মন্ত্রী নন। প্রভুদের চাহিদা পূরণই তাদের প্রধান কাজ। রোজার মাসে পানি সঙ্কটে রাজধানীবাসীর কষ্ট এ সরকারের চোখে লাগে না। বিদ্যুত্ নিয়ে চলছে শতকোটি টাকার বাণিজ্য। এ দুর্নীতির মহোত্সবের জবাব জাতির কাছে একদিন দিতেই হবে।
দেশে চলমান নানা সঙ্কট নিরসনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা জরুরি উল্লেখ করে নিলু বলেন, দেশরক্ষায় এখন আন্দোলনই একমাত্র পথ। আর এজন্য বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মহাঐক্যজোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। রোজার মধ্যেই একটি বৃহত্তর মহাঐক্যজোট গঠনের জন্য তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন