পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১১

৩০ হাজার জাসদকর্মী হত্যা রহস্যের সন্ধানে

প্রথম অধ্যায়:
 
মুজিব পরিবার

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অনুমোদিত রাজনৈতিক দল হচ্ছে 'জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল' বা জাসদ। নবগঠিত এই দলের ৩০ হাজার নেতাকর্মী তৎকালীন জাতীয় রক্ষী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের গুন্ডাদের দ্বারা নিহত হয়েছিল - এরকম একটি প্রচারণা দলটির কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই কিছু কিছু লোকের মধ্যে বিরাট জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে যার সদুত্তর কেউই দিতে পারেনি। এই প্রশ্নের আলোকেই ঘটনার সত্যাসত্য নিরুপণে আজকের আলোচনার অবতারণা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টেবর মেজর আব্দুল জলিলকে প্রেসিডেন্ট এবং আসম রবকে সাধারণ সম্পাদক করে আত্মপ্রকাশ ঘটে নতুন এই রাজনৈতিক দলটির। এই দলের অধিকাংশ নেতারাই ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতারা। তাঁদের মধ্যে শাজাহান সিরাজ, মরহুম কাজী আরেফ আহমেদ, মঈনুদ্দিন খান বাদল, মরহুম নুরে আলম জিকু, আব্দুল মালেক রতন, হাসানুল হক ইনু, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, মাহবুবুল হক, সৈয়দ শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাফর সাজ্জাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এরা সবাই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। জাসদ প্রতিষ্ঠালগ্নের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান যিনি কিছু দিন আগেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন সময়ে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত পলিটিক্যাল কমান্ডো বাহিনী অর্থাৎ মুজিব বাহিনীর শীর্ষ ৪ পরিচালকের একজন ছিলেন। অন্য ৩ জন হচ্ছেন যথাক্রমে বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি। 

ছবি (বাম থেকে): উপরের লাইন-সিরাজুল আলম খান(তাত্ত্বিক), মেজর আঃ জলিল (১৯৪২-১৯৮৯), আসম আঃ রব, কাজী আরেফ আহমেদ(১৯৪২-১৯৯৯), শাজাহান সিরাজ, নিচের লাইন-মইনুদ্দিন খান বাদল, আব্দুল মালেক রতন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, নুর-এ-আলম জিকু(১৯৩৫-২০১০), হাসানুল হক ইনু

মনে করা হয়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ সৃষ্টি রহস্য নিহিত রয়েছে মুজিব বাহিনীর মতই ভারতের মাটিতে। কেননা, তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যু্ক্ত হয়ে ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যান্য প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জয় প্রকাশ নারায়ণ, ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী ‘র’ প্রধান জেনারেল উবান ও আরও কিছুসংখ্যক নেতার সাথে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগলাভ করেন, একাধিক বিষয়ে মতবিনিময় করেন এবং প্রকারান্তরে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদকেও উপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর জাসদের অনেক নেতাই সেদিন আত্মগোপন করেন বা পলাতক থাকেন, পরে সুযোগ বুঝে আবার ফিরেও আসেন। কিন্তু সিরাজুল আলম খান সেই যে দেশত্যাগ করেন অদ্যাবধি আর দেশে ফেরেন নি। শোনা যায়, তিনি জার্মানী বা সুইডেন-এ বসবাস করছেন। আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে এই জাসদও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর জাসদের গণবাহিনী প্রধান কর্ণেল তাহের, সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনু হন্তারক ও দখলদার বাহিনীর সাথে রেডিও বাংলাদেশ, টেলিভিশন, গণভবন, ক্যান্টনমেন্ট প্রভৃতি জায়গায় যান, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে আনুগত্য স্বীকার করেন। 

মুজিব ১৯৭৪ সালে যখন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’র রুপরেখা প্রণয়ন করেন তখন ছোটখাটো মিলিয়ে দেশে মোট রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল ৯টি। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি(মনি সিংহ) ও জাতীয় লীগসহ মোট ৪টি দল বাকশাল-এ একিভুত হয় বাদবাকি ৫টি যথাক্রমে- ন্যাপ(ভাষানী), জাতীয় লীগ(অলি আহাদ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি(লেলিনবাদী) এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল(গোপন সমাজতান্ত্রিক পার্টি)। অন্যান্য ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও চরমপন্থী বামদলগুলি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি বিরোধীতা ও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় তারা আগেই নিষিদ্ধ হয়েছিল, যেমন- জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ (সকল গ্রুপ), লেবার পার্টি(মওলানা মতিন), বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি(হক), সর্বহারা পার্টি(সিরাজ সিকদার), ন্যাপ(মতিন-আলাউদ্দিন-টিপু বিশ্বাস) বা নকসাল (পরে এই অংশটি স্বশস্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা শুরু করলে ভাষানী সংবাদ সম্মেলন করে এদেরকে ন্যাপ থেকে বহিস্কার করেন)। এই মতিন-আলাউদ্দিন-টিপু বিশ্বাস গ্রুপের দীক্ষাগুরু ছিলেন পাবনার (অমূল্য নাথ লাহিড়ী। মতিন-টিপু বিশ্বাস পরে জাতীয় গণফ্রন্ট(মার্ক্স-লেনিন) গঠন করেন এবং আলাউদ্দিন যোগ দেন এরশাদের জাতীয় পার্টিতে, আর মতিন-টিপুর সমর্থকরা বিএনপি-তে। 


সিরাজ সিকদার ঢাকায় অফিস নিয়ে ‘মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র’ চালুর ভিতর দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ১৯৬৭ সালে। কিন্তু ‘৭০ সালে পাকিস্তান সরকার সেটি বন্ধ করে দেয় এবং সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টি নামে একটি গোপন চরমপন্থী সংগঠন গড়ে তোলেন। পরে সিরাজ সিকদার পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হলে মেজর জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে সর্বহারা পার্টির হাল ধরেন। পরে জেনারেল এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এই মেজর জিয়াউদ্দিনকে বঙ্গভবনে আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং প্যান প্যাসিফিক সোনারগাও হোটেলে অনির্দিষ্টকালেরর জন্য বসাবাস ও আলাপ-আলোচনার বন্দোবস্ত করেন।

‘৭৫ সালে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, জাসদসহ অন্যান্য আরও কয়েকটি ক্ষদ্র রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে যখন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল গঠন করা হয় তখন জাসদ এই অভিমত প্রকাশ করে যে, তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন জাতির প্রকৃত মুক্তি সংগ্রামের রূপ নিচ্ছিল ঠিক তখনই সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জাসদকে বন্ধ করে দেয়া চক্রান্তেরই অংশ। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই জাসদ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে আসছিলেন বলে তারা দাবি করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তন বা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ভেতর দিয়ে তাদের সেই আন্দোলন-সংগ্রাম হঠাৎ করেই পরিসমাপ্তি ঘটে। এতে করে মনে করা যায় যে, জাসদ নামের রাজনৈতিক দলটির আসল উদ্দেশ্য তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে ছিল একধরনের অপরিণামদর্শী সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যার ফলে সংকটকালে জাতিকে আরো বেশি সমস্যাসংকুল করে তুলেছিল মাত্র। 

শুধুমাত্র মানুষের কাছে পরিচিতি লাভের জন্যই জাসদ বোমাবাজি, হত্যা, খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস করতে শুরু করে। জাসদ গঠনের পর থেকে আড়াই বছরে প্রায় প্রতিদিনই ট্রেন ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, পুরো গ্রাম ঘিরে গণডাকাতি, হাটবাজার ঘিরে প্রকাশ দিবালোকে শ শ লোকের ওপর একযোগে হামলা, লুট ও ডাকাতির খবর পাওয়া যেতো। এমন দিনও গেছে যে, একই দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪/৫টি ব্যাংক ডাকাতির খবরও মিলতো। ১৯৭২ সাল থেকে রাস্তায় রাস্তায়, ঘর-বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সর্বত্র ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস -জাসদ’ এই বাণী চিকা মারা থাকতো। তারা দাবি তোলেন জনগণের ৮% সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্পদের ৮৫% লুট করে নিয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করছে। (জাসদের ১৯৭৩ সালের ঘোষণাপত্র দ্রষ্টব্য)। জাসদ নিজেকে সত্যিকারের সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ (BCL) এর গণসংগঠক হিসাবে দাবি করে। বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট লীগ গোপন গঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন সিরাজুল আলম খান। যুদ্ধকালীন সময় থেকে জাসদের জন্ম পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ-ই মূলতঃ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ কতৃর্ক ‘গণকন্ঠ’ নামে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে যা প্রকৃতপক্ষে জাসদ-এরই মুখপত্র। কবি আল মাহমুদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। শেখ মুজিব পুত্র শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি সংক্রান্ত খবরটি প্রথম এই গণকণ্ঠে তীব্র বিদ্রুপাত্মক ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে সম্পুর্ণই মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়। সিরাজ সিকদার ও সিরাজুল আলম খান পন্থীরা শুধুমাত্র ‘৭৪ সালেই ৫ জন জাতীয় সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। 

ভাড়াটে খুনীদের দল (যারা একই প্রশিক্ষকের অধীনে অস্ত্র প্রশিক্ষণগ্রহন করেছিল যে প্রশিক্ষক ছিল আল-বদর, আল-শামস ও তালেবানদের প্রশিক্ষক) প্রধান প্রধান আওয়ামী লীগ নেতাসহ ‘৭১ এর বীরদের মধ্যে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল হুদা, কর্ণেল হায়দার, কর্ণেল তাহের (পরবর্তীতে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল)। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সর্বমোট যে ৩৬,০০০ সদস্য (অফিসার ও জওয়ান) কর্মরত ছিলেন এদের মধ্যে ২৮,০০০ জনই ছিলেন ‘৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে আগত, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেন নি বা দেখেন নি। এরা মনেপ্রাণে তখনও স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং পাকিস্তানের প্রেতাত্মাই তাদের সর্বান্তঃকরণ দখল করে ছিল। এইসব সেনাকর্মকর্তারা বলতো, বাংলাদেশের জন্ম যুদ্ধ করে হয়নি, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতীয় হিন্দুদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য একটি উপহার। পূর্বপাকিস্তানের মুসলিমদের জন্য এই স্বাধীনতা কোনও লাভ বয়ে আনবে না। সেবাহিনীর ১২০০ অফিসারের মধ্যে ১০০০ জন ছিলেন এই পাকিস্তান প্রত্যাবাসনকারীদের অংশ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পাকিস্তান বাহিনীর মাত্র ২০০ অফিসার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন যাদের সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ‘মেজর’ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কোনও বাঙ্গালী সেনাকর্মকর্তাকে ‘মেজর’এর বেশি র্যাংক দেবার নিয়ম ছিল না। আবার ১৯৭২-৭৩ সালে নবগঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী(প্যারামিলিটারী)-তে সর্বমোট সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬,০০০ জন। পাকিস্তান ফেরৎ আর্মিরা বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেছিল বুকে কোরান শরীফ ঝুলিয়ে; তারা মনে করতো, এই রক্ষীবাহিনীর দিকে সরকার যতটা নজর দিচ্ছে সেনাবাহিনীর দিকে ততটা দিচ্ছে না। এটাও ধারণা করতো যে, রক্ষী বাহিনী হচ্ছে ভারতের সৃষ্টি, তারা মুক্তিযোদ্ধা, সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বা সার্বিক সহযোগিতা করতেই এদের গড়ে তোলা হচ্ছে। আর সীমিত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসারের পক্ষে বিরাট সংখ্যক পাকিস্তানী সেনাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অস্মভব হয়ে পড়েছিল। তাই বলা যায়, নানা বিষয় নিয়ে ওই ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্ধ ও অবিশ্বাস ধীরে ধীরৈ বেড়েই যাচ্ছিল। একারণে পাকিস্তান ফেরৎ জে. এরশাদের পক্ষে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা যতটা সহজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা জে. জিয়ার পক্ষে ততটা সহজ ছিল না। এজন্যই জে. এরশাদের পক্ষে সৈরাচারী কায়দায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়েছিল।

৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহী-জনতা অভ্যুত্থানের দিন লক্ষ জনতার যে মিছিল রাস্তায় বেরিয়ে আসে, সেই একটি দিন বাদে তাদের আর কখনো রাস্তাঘাটে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনের পর, যে ঝড়োবেগে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল, তেমনি ঝড়োবেগেই তাদের প্রস্থান ঘটল। রাতারাতি তারা কোথায় হারিয়ে গেল তা আজও রহস্যাবৃত হয়ে আছে। 

ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ৭৫ এর ৭ নভেম্বরে আসলে কোনও বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়নি বরং সেটি ছিল কতিপয় জেনারেলের পারস্পারিক তিক্ততা ও রক্তক্ষয়ী ক্ষমতার লড়াই। ৭ নভেম্বর ভোরে রেডিও থেকে বলা হলো, 'মহান সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। জাসদ, বিপ্লবী গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকদের উদ্যোগে জনগণের পক্ষে এই বিপ্লব হয়েছে। ... শীঘ্রই একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা হচ্ছে ... ইত্যাদি।‘ এরপর খুব দ্রুতই ঘোষণা থেকে জাসদ, বিপ্লবী গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নাম উধাও হয়ে যায়। সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান-এর নায়ক কে-এই কথাটি আগে বলা না হলেও হঠাৎ করেই জিয়াউর রহমানের নাম ঘোষণা হতে থাকে। আরও পরে জিয়াউর রহমানকেই অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। পরিবর্তনটা শুধু বেতারে নয় রাজপথেও দেখা যায়। এখানে জাসদ বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা নিষ্ক্রিয় হতে থাকে, আর সে-জায়গা দখল করতে থাকে কট্টর ডানপন্থী লোকেরা। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী মহল বেশ দ্রুতই রাজপথ দখলে নিয়ে নেয়। 
এরপর যে-দৃশ্য অবলোকন করতে হয়, তা হলো সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান নয়, ঘটে গেছে কট্টর ডানপন্থী তথা সামপ্রদায়িক-মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির অভ্যুত্থান। জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের নেতা। জাসদ থেকে বলা হয়, অভ্যুত্থান কার্যতঃ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জানতো যে, শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতা এখন তাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু কাকে বসানো হবে ক্ষমতার মূলকেন্দ্রে তা নিয়ে ছিল চরম দ্বিধা-দ্বন্ধ ও অস্পষ্টতা। সেই যুদ্ধে জিয়া তাঁর বদমেজাজী ও নির্দয় রাজনৈতিক অভিযাত্রায় জয়ী হয়ে বনে গেলেন ‘সুপার প্যাট্রিওট।‘ অন্যান্যদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতায় নিমজ্জিত খালেদ মোশাররফ ও কর্ণেল তাহের-এর স্বীয় অপটুতা ও অদক্ষতার কারণে পরিণত হন বিশ্বাসঘাতকে। তাহেরের ছিল পা হারানোর বিড়ম্বনা আর পরিস্থিতি সামাল দেবার মত অকিঞ্চিৎকর জনবল আর খালেদ মোশাররফের মাথায় ছিল এক অবিস্ফোরিত বোমা যা তিনি ব্যবহারের সুযোগ পাননি। শেষমুহূর্তে জেনারেল এমএজি ওসমানীও তাকে বিভ্রান্ত করেন যার খেসারত খালেদ মোশাররফকে দিতে হয় জীবন দিয়ে! 
স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭২-৭৪ সালে দেশের মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে নিচের বিষয়গুলোর দিকে একবার নজর দেয়া দরকার:
১. ১২ জানুয়ারী ১৯৭২ পরবর্তী ক্ষমতারোহনের পর শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির প্রাপ্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা যেগুলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো ত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। তাঁর সরকার মাত্র এক বছরের মাথায় দেশের জন্য একটি পুর্ণাঙ্গ সংবিধান ও আইন প্রণয়ন করে জনমানুষের সকল অধিকার মানুষের হাতেই তুলে দেন। 
২. সে সময় অবধি বিশ্বের বুকে শুধুমাত্র দু’টি দেশ যথাক্রমে ভারত ও ভুটান-ই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি পেতে আরও কয়েক মাস সময় লেগেছিল, মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে বছরাধিককাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল, আর জাতিসংঘের স্বীকৃতি মিলেছিল স্বাধীনতার আড়াই বছর পর। 
৩. সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পুর্ণটাই ছিল বিধ্বস্ত ও বিচ্ছিন্ন, সবগুলো বিমান-বন্দর ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ব্যবহারের অযোগ্য, চট্টগ্রাম ও মংলা সামুদ্রিক বন্দর দু’টিই ছিল ডুবে যাওয়া জাহাজের স্তুপে আটকানো, বড় বড় রেলওয়ে সেতুগুলোর মধ্যে যেমন হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, ভৈরব ব্রীজ, শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ তৎসহ প্রায় ৩,০০০ আরও ছোটখাটো ব্রীজ ছিল ব্যবহারের অযোগ্য বা একেবারেই বিধ্বস্ত, অনেক অঞ্চলের রেললাইন ছিল উপড়ানো, প্রায় সকল বিআরটিসি বাস ও আভ্যন্তরীণ নৌযানগুলো ছিল ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যবহারের অনুপযুক্ত যেগুলো দেশের এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। 
৪. ৭১ এ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ ছিল পাকিস্তানী সরকারের অধীনস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এরা সবাই ছিল তখন মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন ও অপরাধী, এদের অনেকেই তখনও চাকরীতে যোগদান পর্যন্ত করেননি, প্রায় সবাই ছিল দ্বিধান্বিত, কেউ কেউ ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত আবার কেউবা ছিল অতিউৎসাহী কিংবা চরম অসহযোগিতামূলক মনোভাবাপন্ন, আবার কেউবা মন থেকেই মুজিববিরোধী হয়ে পড়লো। 
৫. দেশের এক কোটি লোক নিজেদের বসতবাড়ি হারিয়েছিল যারা আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতের শরাণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, দেশের ফেরার পর তাদের প্রত্যেকেরই জীবন ও জীবীকার তাগিদ ছিল অলঙ্ঘনীয়, যেখানে সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। 
৬. সরকারী কোষাগার বলতে কিছু ছিল না এবং দেশের পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, পরিকল্পনা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেও কিছু ছিল না, থাকার মধ্যে ছিল সদ্য ভারত-প্রত্যাগত দেশের অস্থায়ী নির্বাসিত মুজিবনগর সরকার। 
৭. দেশের প্রায় ৪ লাখ লোকের কাছে তখন আগ্নেয়াস্ত্র, এদেরে মধ্যে দুই লাখ হচ্ছে মুক্তিবাহিনী, ১০ হাজার মুজিব বাহিনী, ৫ হাজার কাদেরিয়া বাহিনী, ৩ হাজার লতিফ মির্জা বাহিনীসহ বহু আঞ্চলিক বাহিনী, প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব স্বশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী (বেশীরভাগই বামপন্থী), ১ লাখ রাজাকার, পাকিস্তানী প্যারামিলিশিয়া ও পলাতক আর্মি। 
৮. অন্ততঃপক্ষে ৭৫% ভাগ কলকারখানা ছিল পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া যেগুলোর প্রশাসন ও ব্যবস্থা ছিল অবাঙালীদের হাতে, করাখানা চালু রাখার মত চলতি মূলধনও ছিল তাদের কাছেই। 

এদের মধ্যে মুজিব-ঘৃণাকারীদের একমাত্র প্রিয় সিরাজ সিকদার হত্যার কথাই খুব জোর দিয়ে বলা হয় যাকে সরকারের ‘গেস্টাপো’ রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের গুন্ডারা হত্যা করেছিল! শে মুজিব তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের মধ্যে মাত্র আড়াই বছরে ৩০ হাজার জাসদ কর্মীসহ দেড়লাখ লোককে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ করেছিলেন(যখন সিরাজ সিকদার ও সিরাজুল আলম খানের অনুসারী ও সমর্থকরা ঈদের জামাতে ব্রাসফায়ার করে বহু সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ৫ জন জাতীয় সংসদ সদস্যকে হত্যা করেছিল)! এই আলোকে বলতে হয়, সেই সকল ভাড়াটে খুনিরা যারা একই মাস্টার সার্জেন্টের অধীনে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ গ্রহন করেছিল (যারা কিনা ছিল বাংলাদেশের আল-বদর, আল-শামস্ ও আফগানিস্তানের তালেবান) এবং হত্যা করেছিল অধিকাংশ শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকে, অতঃপর নেতৃস্থানীয় বীরদের, যেমন- বিগ্রেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল হুদা, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, কর্ণেল হায়দার, কর্ণেল তাহের(জিয়া যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে) এবং মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তৎসহ আরও ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন