ইলিয়াস খান
ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে, বছরে আয় হবে বিলিয়ন ডলার—ট্রানজিটের পক্ষে এ প্রচারণা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই চলছিল তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখন প্রমাণিত ট্রানজিটের আয় এক শুভঙ্করের ফাঁকি। ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ তেমন কিছুই পাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা গত ক’বছর ধরে অব্যাহতভাবে এ প্রচারণা চালিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সেই ট্রানজিট ভারত পেতে যাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় ট্রানজিট চুক্তি হতে যাচ্ছে। ট্রানজিট চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের আদৌ কোনো লাভ হচ্ছে কি? ট্রানজিটের অবকাঠামো তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এত বড় বিনিয়োগ করলেও দেখা যাচ্ছে ১৫ বছরের আগে বাংলাদেশ ট্রানজিট থেকে কিছুই পাবে না। ভারতকে ট্রানজিট প্রদান এবং
এর লাভ-লোকসান নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেন, লাভ তো দূরের কথা, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। শুধু বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাই নন, ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কার কথা সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এদিকে এতদিন যারা ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, তারাও উল্টো সুরে কথা বলছেন। এখন তারা বলছেন, নিরাপত্তাসহ সবকিছু চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া উচিত।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ট্রানজিট বলা হলেও আসলে ভারতকে দেয়া হচ্ছে করিডোর। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা বলা হলেও আমরা মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবো। আগেও যারা ট্রানজিটের কথা বলেছে তারা আসলে দেশের পঞ্চম বাহিনী। এরা বাংলাদেশের স্বার্থ দেখে না, দেখে দিল্লির স্বার্থ। এজন্যই তারা বিশাল আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
ট্রানজিট প্রসঙ্গে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ট্রানজিটের নামে কী পণ্য পরিবহন করা হবে তা তো কেউ জানে না। ট্রানজিট দেয়া হবে ঢাকার জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দেয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বেশ কিছু দিন যাবত্ সরকার এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ট্রানজিটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে সুবিধা পাওয়া যাবে বলে যেভাবে বাগাড়ম্বর করা হয়েছে, এখন মনে হয় তা আর ধোপে টিকছে না। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে অস্বচ্ছতার অপর নাম ট্রানজিট। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কঠোর গোপনীয় নীতি এবং তড়িঘড়ি দেখে মনে হচ্ছে, যেনতেন প্রকারে একটি ট্রানজিট চুক্তি হবে, যেখানে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকবে, যা বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল। লাভের চেয়ে বাংলাদেশের ক্ষতিটাই বেশি হবে। তিনি বলেন, একইভাবে ট্রানজিট চুক্তি হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার হওয়ার সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হবে বলে দাবি করা হয়েছিল আসলে ততটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ দুই কিস্তির সাড়ে সাত বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আমাদের সুবিধাগুলো এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর ভারতের মনোভাব বর্তমানের তুলনায় আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই সবার আগে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ নিশ্চিত করতে হবে।
বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বলেন, ট্রানজিটসহ অনেক কিছুই দিচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ কী পাচ্ছে সেটিই বড় প্রশ্ন। আমরা পানি পাচ্ছি না, কলকাতায় বঙ্গভূমি আন্দোলন চালানো হচ্ছে। এর কী কোনো সমাধান হচ্ছে? বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অস্ত্র পরিবহন করলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের স্বাধীনতাকামীরা আমাদের টার্গেট করবে। বাংলাদেশ তাহলে আফগানিস্তানে পরিণত হবে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে এতবড় ঝুঁকি আমরা কেন নেবো?
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভারতকে ট্রানজিট দিতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। ২০০৫ সালের ২০ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়া দু বগুড়ায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও বন্দরের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে ভূমিবেষ্টিত প্রতিবেশীদের ব্যবহারের জন্য তা খুলে দেয়া অপরিহার্য। ওই অনুষ্ঠানেই তিনি ভারতকে স্থলপথে ট্রানজিট দেয়ার কথাও বলেন। এরপর এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এসকাপ, সিপিডির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় আয়োজিত সেমিনার সিম্পোজিয়ামে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশকে বিশাল আয়ের পথ উন্মুক্ত করার ওকালতি করা হয়। এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ, সিপিডির অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ সুশীল কয়েকটি মিডিয়া ট্রানজিটের পক্ষে প্রচারণা চালায় যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। কখনও বলা হয় বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ বছরে আয় করবে ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি এডিবি ট্রানজিট নিয়ে এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় বলা হয়, শুরুতে প্রতিবছর ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট ফি থেকে বাংলাদেশের আয় হবে ৫ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা। অবকাঠামো উন্নয়নের পাঁচ বছর পর থেকে বছরে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে। আর দীর্ঘমেয়াদি এ আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি ডলার) বা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাত্ বাংলাদেশ ১৫ বছরের আগে তেমন কিছুই পাবে না। বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলা হয় ১৫ বছর পর।
ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট যেভাবে তৈরি হয় : আঞ্চলিক সহযোগিতার আবরণে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার জন্য ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে এক কর্মশালার আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ওই কর্মশালায় এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জোরাল সুপারিশ করে বলেন, মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থেকে লাভ নেই। আমাদের আঞ্চলিক কানেকটিভিটির (ট্রানজিট) দ্বার উন্মোচন করে দেয়া উচিত। ‘ট্রানজিট না দিলে আমাদের সব সময় অন্য দেশের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর বেঁচে থাকতে হবে’। এ ধরনের যুক্তি তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, আমাদের আর অপেক্ষা করার সময় নেই। এখনই সময় দ্রুত সংযোগ বা ট্রানজিট প্রদান করার। এই সুযোগ কাজে লাগালে আমাদের সামনে শুধু গেইন আর গেইন (অর্জন আর অর্জন)। ড. রহমতউল্লাহ বলেন, নর্ডিক দেশগুলো ট্রানজিটের মাধ্যমে ‘গরম পয়সা’ কামাচ্ছে। মিসরের বন্দর আব্বাসও আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে বিপুল অর্থ আয় করছে। সিঙ্গাপুরও ট্রানজিটের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আয় করে চলেছে। আমাদের এখানেই শুধু ট্রানজিট সংবেদনশীল বিষয় হয়ে রয়েছে। ওই অনুষ্ঠানেই বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের কর্মকর্তা ড. সাদিক আহমেদ বলেন, ট্রানজিটকে আমাদের একটি অর্থনৈতিক বিষয় হিসেবেই দেখতে হবে। এ বিষয়ে রাজনীতিকরণ করা হলে সফলতা পাওয়া যাবে না।
২০১০ সালের নভেম্বরে ড. রহমতউল্লাহ ঢাকায় ট্রানজিটের লাভ-লোকসান বিষয়ে অন্য একটি সেমিনারে এডিবির সমীক্ষা টেনে বলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট হলে ভারতের অন্তত ৭০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় হবে। আর এ সাশ্রয়ের ভাগ পাবে বাংলাদেশও। সমীক্ষা অনুযায়ী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এ থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার করে আয় করতে পারবে।
২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আতিউর রহমানের এনজিও সমুন্নয় আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক আউটলুক’-এর প্র্রকাশনা অনুষ্ঠানে ড. রেহমান সোবহান ট্রানজিট প্রসঙ্গে বলেন, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। শুধু ভারত নয়, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশ ভারত, চীন, নেপাল, ভুটানসহ এ অঞ্চলে বড় ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ট্রানজিটের পক্ষে আগের বছরে বিলিয়ন ডলার আয়ের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে ২০১০ সালের শেষ দিকে এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা (২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আয় করতে পারবে। চলতি বছরের প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বর্ধিত ঋণ (ইসিএফ) দেয়ার কথা বলেছে। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে, এই ঋণ পেতে হলে ভারতকে ট্রানজিট দিতে হবে। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে গত ক’বছর ধরে এভাবেই প্রচারণা চালিয়েছে এডিবি, বিশ্বব্যাংক, সিপিডিসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশীয় এনজিও। ট্রানজিট প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একধাপ এগিয়ে বলেন, বাংলাদেশ হবে ট্রানজিট কান্ট্রি। ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে পরিণত হতে পারে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, আমরা ৪০ বছর অপেক্ষা করেছি, আর নয়। ট্রানজিট দিলে আমাদের হোটেল ব্যবসা জমজমাট হবে। এতে বাংলাদেশের আয়ের পথ উন্মুক্ত হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনিও ট্রানজিট নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখান। আর এদের পালে হাওয়া দিয়েছে দেশের সুশীল কয়েকটি মিডিয়া। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সুর ঘুরিয়ে ফেলেছেন অনেকেই।
ট্রানজিট নিয়ে এখন কে কী বলেন : সিপিডির সমীক্ষায় বিশাল অঙ্কের আয়ের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা বলেছি, সব অবকাঠামো তৈরি করে কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করা গেলে এই আয় সম্ভব। ড. ভট্টাচার্য বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, আমি দেশে ফিরে বিস্তারিত বলব।
সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের ‘বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে’ এবং বছরে বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার আয় হবে—এই বক্তব্য সম্পর্কে বর্তমান অবস্থান জানার জন্য বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ড. রেহমান সোবহানের এই মন্তব্য সম্পর্কে আমার ঠিক জানা নেই। তবে তিনি করে থাকলে তা আয়ের সম্ভাবনার নিরিখেই বলেছেন। কারণ যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে ভালো আয় করা সম্ভব।
এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জোরাল সুপারিশ করেছিলেন। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রানজিট ফি নির্ধারণ হবে উভয় দেশের আলোচনা সাপেক্ষে। ট্রানজিট কার্যক্রম ভালোভাবে চললে ১৫ বছর পর এ থেকে বার্ষিক আয় সাত হাজার কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে, এটা তিনি এখনও মনে করেন। তার কথায়ও এখন দেখা যাচ্ছে ১৫ বছরের আগে বাংলাদেশ কিছুই পাচ্ছে না।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সরকারের তত্পরতা : ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠন করা হলেও বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ‘ট্রানজিট’ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি কার্যকরভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার বাংলাদেশ সফরের সময় করিডোর দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হয়। আনুষ্ঠানিকতার বাকি যতটুকু আছে, তা হবে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। তবে এখন পর্যন্ত ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি-কৌশল প্রণয়নের কোনোই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং খণ্ডিতভাবে কিছু কাজ করে ভারতকে তড়িঘড়ি ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে ট্রানজিট চুক্তিটি সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুতি চলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ২০১০-এর ১১ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রকাশিত ৫০ দফার যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এই ইশতেহারের ২২ নম্বর দফায় আশুগঞ্জ বন্দরকে শুধু ওডিসি পরিবহনের জন্যই নয় বরং ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করে সার্বক্ষণিক পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়। সেই আলোকে এই দফার বাস্তবায়ন করতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান নদীপথে ট্রানজিটের প্রটোকল সংশোধন করা হয়েছে খুবই দ্রুততার সঙ্গে। এখন ওডিসি পরিবহনের লক্ষ্যে আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত সড়কপথ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ওডিসি পরিবহনের পর থেকেই সব ধরনের পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যেই এই পথ খুলে দেয়া হবে।
যৌথ ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। পণ্য পরিবহন করতে ভারতকে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার কথাও এই দফায় বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত যাতে করিডোর কার্যকর করতে পারে সেই কথাও বলা আছে ইশতেহারে।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন : গত বছরের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ট্রানজিট প্রদানের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কিছুদিন বিরতির পর বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আওতায় একটি উচ্চপর্যায়ের ‘কোর কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটি কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারত, নেপাল ও ভুটানকে এই মুহূর্তে পুর্ণাঙ্গ ট্রানজিট-সুবিধা দেয়ার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণেই ট্রানজিট দেয়ার জন্য এখন প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। এজন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়কালে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ট্রান্সশিপমেন্ট চালু করা যেতে পারে। ট্রান্সশিপমেন্ট হলো ভারতীয় পণ্য ভারতীয় বাহনে করে বাংলাদেশের এক সীমান্তে আনার পর বাংলাদেশী বাহনে তুলে আরেক সীমান্তে নামিয়ে দিয়ে আবার ভারতীয় বাহনে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা।’ এ প্রতিবেদনটিকে সরকারের অবস্থানপত্র হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছিলেন। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নীতিনির্ধারক যে ধরনের তত্পরতা শুরু করেছেন, তাতে মনে হয় তারা তিন বছর অপেক্ষা করতে কোনোভাবেই রাজি নন। অবকাঠামো নির্মাণ ও নীতিগত কৌশল নির্ধারণের আগেই তড়িঘড়ি করে একটা চুক্তি করে ফেলাটাই তাদের লক্ষ্য। এরই মধ্যে তাদের একাধিক বক্তব্যে এটি স্পষ্ট।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূলত মাশুল আদায়ের মাধ্যমেই বিনিয়োগের অর্থ আসবে। তবে তা নির্ভর করবে মাশুলের হারের ওপর। আবার মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি নির্ভর করবে ট্রানজিট-সুবিধা গ্রহণকারী ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সমঝোতার ওপর। কেননা এসব দেশ কোন কোন রুট ব্যবহার করবে, আর প্রতিবছর কী পরিমাণ পণ্য বহন করবে, তার ওপরও বিনিয়োগ ও মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি জড়িত। এজন্য প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
ট্রানজিট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়নি : ট্রানজিট নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হলেও জাতীয় সংসদে বিষয়টির ওপর সরকারের অবস্থানপত্র নিয়ে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না। ট্যারিফ কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি আজও প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ট্রানজিট সংক্রান্ত যে সমীক্ষা শেষ করেছে, সেটিও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, ট্রানজিট নিয়ে সরকার কেন এত লুকোচুরি করছে। সরকারের স্ববিরোধী বক্তব্য এবং ঘন ঘন মতের পরিবর্তন সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রানজিট নিয়ে এখন প্রশ্ন : ভারত বা নেপাল-ভুটানকে ট্রানজিট দিলে কী লাভ হবে—এই প্রশ্ন এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সমীক্ষা অনুসারে অবকাঠামো উন্নয়নের পাঁচ বছর পর থেকে বছরে বাংলাদেশের ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি এ আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এর আগে শুরুতে প্রতিবছর মাশুল থেকে আয় হবে ৫ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সমীক্ষায় রেল অবকাঠামো উন্নয়নে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে বছরে দেড় কোটি থেকে তিন কোটি ডলার পর্যন্ত বাংলাদেশের আয় হতে পারে বলে হিসাব দেয়া হয়েছে। বিআইডিএস রেলপথে ট্র্রানজিট দেয়াকেই অধিকতর বাস্তবসম্মত মনে করে। যদি এডিবির হিসাবকেই গ্রহণযোগ্য ধরা হয় তাহলেও বলতে হয়, ট্রানজিট থেকে আসলে তেমন একটা আর্থিক লাভ নেই। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে এক হাজার ৯৭ কোটি ডলার। গড়ে প্রতি মাসে ৯১ কোটি ডলার আর দৈনিক তিন কোটি ডলার। সেখানে সরকারের বিনিয়োগ অনেক কম। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ৫ বছরে ৫০ কোটি ডলারের জন্য এখন কেন ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে?
রাস্তা মেরামত, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ এবং পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে খরচ নেয়া হবে তাই ট্রানজিট ফি হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রতি ১০০ কিলোমিটারের জন্য ট্রাকপ্রতি ১১ দশমিক ২ ডলার এবং যাত্রী বহনকারী বড় বাসের জন্য ৫ ডলার নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে। কিন্তু নৌপথে জাহাজ চলাচলের ওপর ফি নেয়ার বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই এ নীতিমালায়।
সড়ক, রেল ও নৌরুট এবং স্থল ও সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিচালন ব্যয় উত্তোলন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার ৯২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এদিকে ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কী নেয়া হবে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে এখনও মতভেদ রয়েছে। ভারতের কাছ থেকে আদৌ কিছু নেয়া হবে কিনা সে ব্যাপারেই সরকারের নানাজনের নানামত। প্রথম দিকে দেশের মানুষকে সরকারের তরফ থেকে এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া বাবদ যে অর্থ আসবে তা দিয়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে। কিন্তু ভারত যখন জানিয়ে দিল ট্রানজিট থেকে শুল্ক ফি ইত্যাদি আদায়ের কোনো বিধান আন্তর্জাতিক আইনে নেই, তখন বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর স্বপ্ন ধসে গেল।
এর পরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ট্রানজিট বাবদ ভারতের কাছ থেকে ‘একটা কিছু’ পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, ট্রানজিট বাবদ ভারতের কাছ থেকে কোনো অর্থ গ্রহণে তিনি ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেছেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ হবে অভদ্রতা।
ট্রানজিট দেয়া নিয়ে সরকারের পাগলপ্রায় অবস্থায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) যারা আগে ট্রানজিটের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল, তারাও বলেছে, ট্রানজিট দিতে হলে তা অবশ্যই তড়িঘড়ি করে অসম্পূর্ণ বা খণ্ডিত কোনো নীতিমালা ও প্রক্রিয়ার আওতায় দেয়া সঙ্গত নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রানজিট দেয়ার সক্ষমতা ও প্রস্তুতি বাংলাদেশের কতটুকু আছে তা বিবেচনা করা দরকার। বাস্তবতা হলো, এই সক্ষমতা ও প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আর তাই ঘাটতি পূরণ না করে হঠাত্ করে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ফেললে তার পরিণতি শুভ হবে না বলে মনে করে সিপিডি।
ট্রানজিট বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. কেএস মুরশিদ বলেন, ট্রানজিট দেয়া নিয়ে দু’দেশের মধ্যে নীতিগত চুক্তি হয়েছে। সরকার চাইবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো চুক্তি সম্পন্ন করতে। ট্রানজিট নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম গবেষণা হয়েছে। ট্রানজিট নিয়ে এত তাড়াহুড়া করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা যদি ৪০ বছর অপেক্ষা করতে পারি, তাহলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে অসুবিধা কোথায়। তড়িঘড়ি করার পেছনে কী যুক্তি আছে, তা আমি জানি না। এটা কেবল আমাদের স্বার্থকেই বিঘ্নিত করবে।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা গত ক’বছর ধরে অব্যাহতভাবে এ প্রচারণা চালিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সেই ট্রানজিট ভারত পেতে যাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় ট্রানজিট চুক্তি হতে যাচ্ছে। ট্রানজিট চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের আদৌ কোনো লাভ হচ্ছে কি? ট্রানজিটের অবকাঠামো তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এত বড় বিনিয়োগ করলেও দেখা যাচ্ছে ১৫ বছরের আগে বাংলাদেশ ট্রানজিট থেকে কিছুই পাবে না। ভারতকে ট্রানজিট প্রদান এবং
এর লাভ-লোকসান নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেন, লাভ তো দূরের কথা, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। শুধু বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাই নন, ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কার কথা সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এদিকে এতদিন যারা ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, তারাও উল্টো সুরে কথা বলছেন। এখন তারা বলছেন, নিরাপত্তাসহ সবকিছু চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া উচিত।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ট্রানজিট বলা হলেও আসলে ভারতকে দেয়া হচ্ছে করিডোর। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা বলা হলেও আমরা মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবো। আগেও যারা ট্রানজিটের কথা বলেছে তারা আসলে দেশের পঞ্চম বাহিনী। এরা বাংলাদেশের স্বার্থ দেখে না, দেখে দিল্লির স্বার্থ। এজন্যই তারা বিশাল আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
ট্রানজিট প্রসঙ্গে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ট্রানজিটের নামে কী পণ্য পরিবহন করা হবে তা তো কেউ জানে না। ট্রানজিট দেয়া হবে ঢাকার জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দেয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বেশ কিছু দিন যাবত্ সরকার এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ট্রানজিটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে সুবিধা পাওয়া যাবে বলে যেভাবে বাগাড়ম্বর করা হয়েছে, এখন মনে হয় তা আর ধোপে টিকছে না। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে অস্বচ্ছতার অপর নাম ট্রানজিট। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কঠোর গোপনীয় নীতি এবং তড়িঘড়ি দেখে মনে হচ্ছে, যেনতেন প্রকারে একটি ট্রানজিট চুক্তি হবে, যেখানে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকবে, যা বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল। লাভের চেয়ে বাংলাদেশের ক্ষতিটাই বেশি হবে। তিনি বলেন, একইভাবে ট্রানজিট চুক্তি হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার হওয়ার সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হবে বলে দাবি করা হয়েছিল আসলে ততটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ দুই কিস্তির সাড়ে সাত বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আমাদের সুবিধাগুলো এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর ভারতের মনোভাব বর্তমানের তুলনায় আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই সবার আগে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ নিশ্চিত করতে হবে।
বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বলেন, ট্রানজিটসহ অনেক কিছুই দিচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ কী পাচ্ছে সেটিই বড় প্রশ্ন। আমরা পানি পাচ্ছি না, কলকাতায় বঙ্গভূমি আন্দোলন চালানো হচ্ছে। এর কী কোনো সমাধান হচ্ছে? বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অস্ত্র পরিবহন করলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের স্বাধীনতাকামীরা আমাদের টার্গেট করবে। বাংলাদেশ তাহলে আফগানিস্তানে পরিণত হবে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে এতবড় ঝুঁকি আমরা কেন নেবো?
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভারতকে ট্রানজিট দিতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। ২০০৫ সালের ২০ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়া দু বগুড়ায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও বন্দরের সামর্থ্য বৃদ্ধি করে ভূমিবেষ্টিত প্রতিবেশীদের ব্যবহারের জন্য তা খুলে দেয়া অপরিহার্য। ওই অনুষ্ঠানেই তিনি ভারতকে স্থলপথে ট্রানজিট দেয়ার কথাও বলেন। এরপর এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এসকাপ, সিপিডির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় আয়োজিত সেমিনার সিম্পোজিয়ামে ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশকে বিশাল আয়ের পথ উন্মুক্ত করার ওকালতি করা হয়। এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ, সিপিডির অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ সুশীল কয়েকটি মিডিয়া ট্রানজিটের পক্ষে প্রচারণা চালায় যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। কখনও বলা হয় বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ বছরে আয় করবে ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি এডিবি ট্রানজিট নিয়ে এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় বলা হয়, শুরুতে প্রতিবছর ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট ফি থেকে বাংলাদেশের আয় হবে ৫ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা। অবকাঠামো উন্নয়নের পাঁচ বছর পর থেকে বছরে বাংলাদেশ ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে। আর দীর্ঘমেয়াদি এ আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি ডলার) বা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাত্ বাংলাদেশ ১৫ বছরের আগে তেমন কিছুই পাবে না। বিলিয়ন ডলার আয়ের কথা বলা হয় ১৫ বছর পর।
ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট যেভাবে তৈরি হয় : আঞ্চলিক সহযোগিতার আবরণে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার জন্য ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে এক কর্মশালার আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ওই কর্মশালায় এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জোরাল সুপারিশ করে বলেন, মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থেকে লাভ নেই। আমাদের আঞ্চলিক কানেকটিভিটির (ট্রানজিট) দ্বার উন্মোচন করে দেয়া উচিত। ‘ট্রানজিট না দিলে আমাদের সব সময় অন্য দেশের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর বেঁচে থাকতে হবে’। এ ধরনের যুক্তি তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, আমাদের আর অপেক্ষা করার সময় নেই। এখনই সময় দ্রুত সংযোগ বা ট্রানজিট প্রদান করার। এই সুযোগ কাজে লাগালে আমাদের সামনে শুধু গেইন আর গেইন (অর্জন আর অর্জন)। ড. রহমতউল্লাহ বলেন, নর্ডিক দেশগুলো ট্রানজিটের মাধ্যমে ‘গরম পয়সা’ কামাচ্ছে। মিসরের বন্দর আব্বাসও আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে বিপুল অর্থ আয় করছে। সিঙ্গাপুরও ট্রানজিটের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আয় করে চলেছে। আমাদের এখানেই শুধু ট্রানজিট সংবেদনশীল বিষয় হয়ে রয়েছে। ওই অনুষ্ঠানেই বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের কর্মকর্তা ড. সাদিক আহমেদ বলেন, ট্রানজিটকে আমাদের একটি অর্থনৈতিক বিষয় হিসেবেই দেখতে হবে। এ বিষয়ে রাজনীতিকরণ করা হলে সফলতা পাওয়া যাবে না।
২০১০ সালের নভেম্বরে ড. রহমতউল্লাহ ঢাকায় ট্রানজিটের লাভ-লোকসান বিষয়ে অন্য একটি সেমিনারে এডিবির সমীক্ষা টেনে বলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট হলে ভারতের অন্তত ৭০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় হবে। আর এ সাশ্রয়ের ভাগ পাবে বাংলাদেশও। সমীক্ষা অনুযায়ী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এ থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার করে আয় করতে পারবে।
২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আতিউর রহমানের এনজিও সমুন্নয় আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক আউটলুক’-এর প্র্রকাশনা অনুষ্ঠানে ড. রেহমান সোবহান ট্রানজিট প্রসঙ্গে বলেন, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। শুধু ভারত নয়, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশ ভারত, চীন, নেপাল, ভুটানসহ এ অঞ্চলে বড় ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ট্রানজিটের পক্ষে আগের বছরে বিলিয়ন ডলার আয়ের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে ২০১০ সালের শেষ দিকে এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা (২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আয় করতে পারবে। চলতি বছরের প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বর্ধিত ঋণ (ইসিএফ) দেয়ার কথা বলেছে। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে, এই ঋণ পেতে হলে ভারতকে ট্রানজিট দিতে হবে। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে গত ক’বছর ধরে এভাবেই প্রচারণা চালিয়েছে এডিবি, বিশ্বব্যাংক, সিপিডিসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশীয় এনজিও। ট্রানজিট প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একধাপ এগিয়ে বলেন, বাংলাদেশ হবে ট্রানজিট কান্ট্রি। ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে পরিণত হতে পারে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, আমরা ৪০ বছর অপেক্ষা করেছি, আর নয়। ট্রানজিট দিলে আমাদের হোটেল ব্যবসা জমজমাট হবে। এতে বাংলাদেশের আয়ের পথ উন্মুক্ত হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনিও ট্রানজিট নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখান। আর এদের পালে হাওয়া দিয়েছে দেশের সুশীল কয়েকটি মিডিয়া। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সুর ঘুরিয়ে ফেলেছেন অনেকেই।
ট্রানজিট নিয়ে এখন কে কী বলেন : সিপিডির সমীক্ষায় বিশাল অঙ্কের আয়ের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা বলেছি, সব অবকাঠামো তৈরি করে কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করা গেলে এই আয় সম্ভব। ড. ভট্টাচার্য বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, আমি দেশে ফিরে বিস্তারিত বলব।
সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের ‘বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে’ এবং বছরে বাংলাদেশের এক বিলিয়ন ডলার আয় হবে—এই বক্তব্য সম্পর্কে বর্তমান অবস্থান জানার জন্য বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ড. রেহমান সোবহানের এই মন্তব্য সম্পর্কে আমার ঠিক জানা নেই। তবে তিনি করে থাকলে তা আয়ের সম্ভাবনার নিরিখেই বলেছেন। কারণ যথাযথ অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে ভালো আয় করা সম্ভব।
এসকাপের সাবেক পরিচালক ড. রহমতউল্লাহ ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জোরাল সুপারিশ করেছিলেন। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রানজিট ফি নির্ধারণ হবে উভয় দেশের আলোচনা সাপেক্ষে। ট্রানজিট কার্যক্রম ভালোভাবে চললে ১৫ বছর পর এ থেকে বার্ষিক আয় সাত হাজার কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে, এটা তিনি এখনও মনে করেন। তার কথায়ও এখন দেখা যাচ্ছে ১৫ বছরের আগে বাংলাদেশ কিছুই পাচ্ছে না।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সরকারের তত্পরতা : ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠন করা হলেও বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ‘ট্রানজিট’ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি কার্যকরভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার বাংলাদেশ সফরের সময় করিডোর দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হয়। আনুষ্ঠানিকতার বাকি যতটুকু আছে, তা হবে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। তবে এখন পর্যন্ত ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি-কৌশল প্রণয়নের কোনোই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং খণ্ডিতভাবে কিছু কাজ করে ভারতকে তড়িঘড়ি ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে ট্রানজিট চুক্তিটি সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুতি চলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ২০১০-এর ১১ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রকাশিত ৫০ দফার যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এই ইশতেহারের ২২ নম্বর দফায় আশুগঞ্জ বন্দরকে শুধু ওডিসি পরিবহনের জন্যই নয় বরং ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করে সার্বক্ষণিক পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়। সেই আলোকে এই দফার বাস্তবায়ন করতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান নদীপথে ট্রানজিটের প্রটোকল সংশোধন করা হয়েছে খুবই দ্রুততার সঙ্গে। এখন ওডিসি পরিবহনের লক্ষ্যে আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত সড়কপথ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ওডিসি পরিবহনের পর থেকেই সব ধরনের পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যেই এই পথ খুলে দেয়া হবে।
যৌথ ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। পণ্য পরিবহন করতে ভারতকে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার কথাও এই দফায় বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত যাতে করিডোর কার্যকর করতে পারে সেই কথাও বলা আছে ইশতেহারে।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন : গত বছরের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ট্রানজিট প্রদানের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কিছুদিন বিরতির পর বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আওতায় একটি উচ্চপর্যায়ের ‘কোর কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটি কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারত, নেপাল ও ভুটানকে এই মুহূর্তে পুর্ণাঙ্গ ট্রানজিট-সুবিধা দেয়ার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণেই ট্রানজিট দেয়ার জন্য এখন প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। এজন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়কালে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ট্রান্সশিপমেন্ট চালু করা যেতে পারে। ট্রান্সশিপমেন্ট হলো ভারতীয় পণ্য ভারতীয় বাহনে করে বাংলাদেশের এক সীমান্তে আনার পর বাংলাদেশী বাহনে তুলে আরেক সীমান্তে নামিয়ে দিয়ে আবার ভারতীয় বাহনে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা।’ এ প্রতিবেদনটিকে সরকারের অবস্থানপত্র হিসেবে অনেকে বিবেচনা করছিলেন। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নীতিনির্ধারক যে ধরনের তত্পরতা শুরু করেছেন, তাতে মনে হয় তারা তিন বছর অপেক্ষা করতে কোনোভাবেই রাজি নন। অবকাঠামো নির্মাণ ও নীতিগত কৌশল নির্ধারণের আগেই তড়িঘড়ি করে একটা চুক্তি করে ফেলাটাই তাদের লক্ষ্য। এরই মধ্যে তাদের একাধিক বক্তব্যে এটি স্পষ্ট।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূলত মাশুল আদায়ের মাধ্যমেই বিনিয়োগের অর্থ আসবে। তবে তা নির্ভর করবে মাশুলের হারের ওপর। আবার মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি নির্ভর করবে ট্রানজিট-সুবিধা গ্রহণকারী ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সমঝোতার ওপর। কেননা এসব দেশ কোন কোন রুট ব্যবহার করবে, আর প্রতিবছর কী পরিমাণ পণ্য বহন করবে, তার ওপরও বিনিয়োগ ও মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি জড়িত। এজন্য প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
ট্রানজিট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়নি : ট্রানজিট নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হলেও জাতীয় সংসদে বিষয়টির ওপর সরকারের অবস্থানপত্র নিয়ে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না। ট্যারিফ কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি আজও প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ট্রানজিট সংক্রান্ত যে সমীক্ষা শেষ করেছে, সেটিও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, ট্রানজিট নিয়ে সরকার কেন এত লুকোচুরি করছে। সরকারের স্ববিরোধী বক্তব্য এবং ঘন ঘন মতের পরিবর্তন সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রানজিট নিয়ে এখন প্রশ্ন : ভারত বা নেপাল-ভুটানকে ট্রানজিট দিলে কী লাভ হবে—এই প্রশ্ন এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সমীক্ষা অনুসারে অবকাঠামো উন্নয়নের পাঁচ বছর পর থেকে বছরে বাংলাদেশের ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি এ আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এর আগে শুরুতে প্রতিবছর মাশুল থেকে আয় হবে ৫ কোটি ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সমীক্ষায় রেল অবকাঠামো উন্নয়নে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে বছরে দেড় কোটি থেকে তিন কোটি ডলার পর্যন্ত বাংলাদেশের আয় হতে পারে বলে হিসাব দেয়া হয়েছে। বিআইডিএস রেলপথে ট্র্রানজিট দেয়াকেই অধিকতর বাস্তবসম্মত মনে করে। যদি এডিবির হিসাবকেই গ্রহণযোগ্য ধরা হয় তাহলেও বলতে হয়, ট্রানজিট থেকে আসলে তেমন একটা আর্থিক লাভ নেই। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে এক হাজার ৯৭ কোটি ডলার। গড়ে প্রতি মাসে ৯১ কোটি ডলার আর দৈনিক তিন কোটি ডলার। সেখানে সরকারের বিনিয়োগ অনেক কম। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ৫ বছরে ৫০ কোটি ডলারের জন্য এখন কেন ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে?
রাস্তা মেরামত, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ এবং পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে খরচ নেয়া হবে তাই ট্রানজিট ফি হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রতি ১০০ কিলোমিটারের জন্য ট্রাকপ্রতি ১১ দশমিক ২ ডলার এবং যাত্রী বহনকারী বড় বাসের জন্য ৫ ডলার নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে। কিন্তু নৌপথে জাহাজ চলাচলের ওপর ফি নেয়ার বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই এ নীতিমালায়।
সড়ক, রেল ও নৌরুট এবং স্থল ও সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিচালন ব্যয় উত্তোলন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার ৯২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এদিকে ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কী নেয়া হবে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে এখনও মতভেদ রয়েছে। ভারতের কাছ থেকে আদৌ কিছু নেয়া হবে কিনা সে ব্যাপারেই সরকারের নানাজনের নানামত। প্রথম দিকে দেশের মানুষকে সরকারের তরফ থেকে এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া বাবদ যে অর্থ আসবে তা দিয়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে। কিন্তু ভারত যখন জানিয়ে দিল ট্রানজিট থেকে শুল্ক ফি ইত্যাদি আদায়ের কোনো বিধান আন্তর্জাতিক আইনে নেই, তখন বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর স্বপ্ন ধসে গেল।
এর পরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ট্রানজিট বাবদ ভারতের কাছ থেকে ‘একটা কিছু’ পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, ট্রানজিট বাবদ ভারতের কাছ থেকে কোনো অর্থ গ্রহণে তিনি ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেছেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ হবে অভদ্রতা।
ট্রানজিট দেয়া নিয়ে সরকারের পাগলপ্রায় অবস্থায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) যারা আগে ট্রানজিটের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল, তারাও বলেছে, ট্রানজিট দিতে হলে তা অবশ্যই তড়িঘড়ি করে অসম্পূর্ণ বা খণ্ডিত কোনো নীতিমালা ও প্রক্রিয়ার আওতায় দেয়া সঙ্গত নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রানজিট দেয়ার সক্ষমতা ও প্রস্তুতি বাংলাদেশের কতটুকু আছে তা বিবেচনা করা দরকার। বাস্তবতা হলো, এই সক্ষমতা ও প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আর তাই ঘাটতি পূরণ না করে হঠাত্ করে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ফেললে তার পরিণতি শুভ হবে না বলে মনে করে সিপিডি।
ট্রানজিট বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. কেএস মুরশিদ বলেন, ট্রানজিট দেয়া নিয়ে দু’দেশের মধ্যে নীতিগত চুক্তি হয়েছে। সরকার চাইবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো চুক্তি সম্পন্ন করতে। ট্রানজিট নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম গবেষণা হয়েছে। ট্রানজিট নিয়ে এত তাড়াহুড়া করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা যদি ৪০ বছর অপেক্ষা করতে পারি, তাহলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে অসুবিধা কোথায়। তড়িঘড়ি করার পেছনে কী যুক্তি আছে, তা আমি জানি না। এটা কেবল আমাদের স্বার্থকেই বিঘ্নিত করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন